
শুধু সীমান্ত নয়, কাজের ক্ষেত্রেও নানা বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ৷ নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো চাকরির শূন্যপদ যাচাই, বেতনের সীমারেখা বেঁধে দেয়াসহ বিভিন্ন নিয়ম আরোপ করে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়েছে৷
অস্ট্রিয়া, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো কর্মসংস্থানের বাজারে অভিবাসীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে ক্রমাগত কড়াকড়ি আরোপ করে যাচ্ছে৷ শুধু সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ নয়, চাকরিদাতারা কাদের নিয়োগ দেবেন, চুক্তির শর্ত কী হবে, বেতন কত হবে, এসব বিষয়েও সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করছে৷
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এই গবেষণা শিরোনাম: ‘দ্য রিটার্ন অব দ্য স্টেট: হাউ ইউরোপিয়ান গভর্নমেন্ট রেগুলেট লেবার মার্কেট কমপিটিশন ফ্রম মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স’৷
বিধিনিষেধের ধরন
দেশগুলোতে প্রবেশের পর অভিবাসীদের কর্মসংস্থান বাজারে তিন ধরনের বাধা চিহ্নিত করেছেন গবেষকেরা৷
চাকরির শূন্যপদ যাচাই:
বিদেশি কর্মী নিয়োগে চাকরিদাতাদের নিশ্চিত করতে হবে যে শূন্য পদটির জন্য স্থানীয় কোনো কর্মী নেই৷
বেতন ও যোগ্যতার মাপকাঠি:
চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার জন্য বেতন বা যোগ্যতার ক্ষেত্রে অভিবাসীদের জন্য উঁচু সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়৷
এক চাকরিতে থাকার সময়সীমা:
অনেক নতুন অভিবাসীর ক্ষেত্রে চাকরি পরিবর্তনের জন্য একজন নিয়োগকারীর অধীনে অন্তত এক বছর কাজ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হচ্ছে৷
আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এর সঙ্গে আরো বাড়তি বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়৷ চাকরির অনুমতি পাওয়ার জন্য তাদের মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হয়৷
চার দেশ, অভিন্ন কৌশল
চারটি দেশ প্রায় একই ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে এগুচ্ছে৷ যেমন:
অস্ট্রিয়া
২০০৪ সালে অভিবাসীদের জন্য রেড-হোয়াইট-রেড কার্ড চালু করে৷ এর অধীনে চাকরির শূন্যপদ যাচাই, বেতনের সীমা, দক্ষ কর্মীদের এক নিয়োগকর্তার অধীনে অন্তত এক বছর কাজের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়৷
জার্মানি
২০০৫ সালে অভিবাসী আইনে বসবাসের অনুমোদনের কাঠামো পরিবর্তন করে৷ পরবর্তীতে ব্লু কার্ড চালু করা হয়৷ বেতনের সীমা, শূন্যপদ যাচাই, সেই সঙ্গে প্রথম নিয়োগকারীর অধীনে অন্তত দুই বছর কাজের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়৷
আয়ারল্যান্ড
দেশটিতে আরো কঠিন কিছু নিয়ম আরোপ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে রয়েছে, কোনো অভিবাসীকে নিয়োগ দেয়ার আট সপ্তাহ আগে চাকরির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্থানীয় কর্মীর খোঁজ করা, বেতনের সীমা ৩২ হাজার থেকে ৬৪ হাজার ইউরো বেঁধে দেয়া এবং এক চাকরিদাতার অধীনে ন্যূনতম এক বছর চাকরি করার বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেয়া৷
যুক্তরাজ্য
২০০৮ সালে পয়েন্টভিত্তিক ভিসা ব্যবস্থা চালু করে৷ চাকরিদাতাদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিশ্চিত করতে হয় যে কোনো স্থানীয় কর্মীকে তারা পায়নি৷ কর্মীদেরকে স্পন্সরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকতে হয়৷ বেতনের সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার পাশাপাশি উচ্চ দক্ষ কর্মীদের টায়ার ওয়ান ভিসা ২০১১ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়৷
বিদেশ থেকে দক্ষকর্মী আকর্ষণ
অভিবাসীদের জন্য চাকরির বাজারে নানা বাধ্যবাধকতা আরোপের পদক্ষেপ যেমন নেয়া হচ্ছে তার পাশাপাশি বিদেশি মেধাবীদের আকর্ষণে নতুন নতুন কর্মসূচিও নিচ্ছে সরকারগুলো৷
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যে দক্ষ কর্মীর জন্য অনুমোদিত স্পন্সরের সংখ্যা এক লাখ ১০ হাজার ৫০০ জনে পৌঁছেছে৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সবুজ জ্বালানি, অনুজীববিজ্ঞানসহ বিভিন্ন খাতে উচ্চ দক্ষ কর্মীদের আকর্ষণে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে৷
জার্মানি নতুন অপরচুনিটি কার্ড চালু করেছে৷ পয়েন্টভিত্তিক এই স্কিমের আওতায় দেশটিতে সংকট রয়েছে এমন খাতের বিদেশি যোগ্যতাসম্পন্নরা এসে চাকরি খোঁজার সুযোগ পাবেন৷ আফ্রিকার কেনিয়া কিংবা ভারতের মতো দেশগুলোর কর্মীদের লক্ষ্য করে এই স্কিমটি চালু করা হয়েছে৷
প্রযুক্তি, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতের কর্মীদের নিয়োগের অনুমতি অব্যাহত রেখেছে আয়ারল্যান্ড৷ আর অস্ট্রিয়া ঘাটতি থাকা খাতগুলোর জন্য উচ্চ দক্ষ অভিবাসীদের নিয়োগ দিতে তাদের রেড-হোয়াইট-রেড কার্ডকে ব্যবহার করছে৷
বিদেশি কর্মীর গুরুত্ব
গত সপ্তাহে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন ল্যাগার্দ জানিয়েছেন, বিদেশে জন্ম নেয়া কর্মীরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাকরির বাজারের মাত্র নয় শতাংশ দখল করে আছেন৷ কিন্তু ২০২২ সালের পর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধিতে অর্ধেক অবদান তাদের৷ হাসপাতাল, নির্মাণ খাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্প বিদেশি কর্মী নির্ভর৷
তারপরও অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি ও জনতুষ্টিবাদী কথা শক্তিশালী অবস্থান করে নিচ্ছে৷ জার্মানিতে কর্মী সংকট থাকলেও আশ্রয়প্রার্থীদের কাজের ক্ষেত্রে নানা বাধা নিষেধ আরোপ করা হচ্ছে৷ যুক্তরাজ্যে ভিসার ব্যবস্থায় কড়াকড়ি আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার৷ তবে নিয়োগকারীরা সতর্ক করে বলেছেন বিদেশিদের নিয়োগ হ্রাস করা হলে সেবা, নির্মাণ, আতিথেয়তা খাতে বিপর্যয় নামবে৷
গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ধরনের পদক্ষেপগুলো ব্যাপক অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে৷ অভিবাসীদের চাকরির বাজারের প্রবেশ সীমাবদ্ধ করে দিলে পরিচর্যা খাত, নির্মাণ, কৃষি এবং অন্যান্য শিল্পে কর্মী ঘাটতি আরো প্রবল হবে৷