
চীনের বাণিজ্যিক লেনদেনে ইউয়ানের (চীনা মুদ্রা) অংশ প্রায় ৫৩% এ পৌঁছেছে, যা ডলারের ৪৭ শতাংশ শেয়ারকে ছাড়িয়ে গেছে। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনটি ঘটেছে এমন একটি প্রেক্ষাপটে যখন ২০১০ সালে চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যে ইউয়ানের অংশ ছিল প্রায় শূন্য।
পার্স টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রথমবারের মতো ইউয়ান চীনের আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে ইউয়ানের অংশ ৫৩ শতাংশে পৌঁছেছে এবং ডলারের অংশ নেমে এসেছে ৪৭ শতাংশে।
এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক সাফল্য নয়, বরং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা, যেখানে আর ডলার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে না এবং বিশ্ব দ্রুতই ডিডলারাইজেশন (ডলার ভিন্ন অন্য মুদ্রায় লেনদেন)-এর পথে এগোচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডলার বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত। এই আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ, মূলধনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক নীতি প্রভাবিত করার সুযোগ দিয়েছে।
বিশেষত সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা, ইরানের বিরুদ্ধে আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং চীনের বিরুদ্ধে অনুরূপ হুমকি, সবই- এই নীতির উদাহরণ। এর ফলে বহু দেশ বুঝতে পেরেছে যে, ডলারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এক বড় কৌশলগত ঝুঁকি।
এই ঝুঁকির প্রতিক্রিয়ায়, চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান এবং এমনকি কিছু ইউরোপীয় দেশ ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে প্রচেষ্টা শুরু করেছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে জাতীয় মুদ্রা ব্যবহার, সুইফট (SWIFT)-এর থেকে স্বাধীন পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি এবং বাণিজ্যিক অংশীদারদের সাথে মুদ্রা বিনিময় চুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই প্রচেষ্টা প্রসারিত হচ্ছে।
এই পথের অগ্রদূত রাশিয়া ঘোষণা করেছে যে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে তার বাণিজ্যিক লেনদেন ৪৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে এবং এই লেনদেনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ স্থানীয় মুদ্রায় করা হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জোর দিয়েছেন, এই প্রক্রিয়াটি পদ্ধতিগতভাবে প্রসারিত হচ্ছে এবং এর লক্ষ্য হল- দেশগুলোর আর্থিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা।
চীনও এই পথে বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। বেইজিং সরকার ইউয়ানকে ডলারের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন— মূলধন নিয়ন্ত্রণে শিথিলতা, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য চীনা বাজার আকর্ষণীয় করা, বিদেশি দেশগুলোকে ইউয়ানভিত্তিক বন্ড ইস্যুর সুযোগ দেওয়া, এবং সুইফট-এর বিকল্প হিসেবে আন্তঃব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম CIPS নামক আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এছাড়া, ইউয়ানভিত্তিক ডিজিটাল মুদ্রা mBridge প্রকল্প ইতোমধ্যে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের (BIS) তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালে বিশ্বব্যাপী ইউয়ানের দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৮১৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং বৈশ্বিক মুদ্রা লেনদেনে এর অংশ ৮.৫% এ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ইউয়ানকে বিশ্বের পঞ্চম সর্বাধিক লেনদেনকৃত মুদ্রার স্থানে এনেছে এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের সাথে এর ব্যবধান কমিয়ে এনেছে। বৈশ্বিক মুদ্রা লেনদেনে পাউন্ডের অংশ ১০.২% এ পৌঁছালেও, যা তিন বছর আগের তুলনায় কম, ইউয়ান দ্রুত গতিতে বিশ্বের চতুর্থ স্থানের দিকে এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু এই পরিবর্তন কেবল পরিসংখ্যানে সীমাবদ্ধ নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক চীন থেকে আমদানিকৃত সকল পণ্যের উপর ১০০% শুল্ক ঘোষণার পর, মার্কিন ও বিশ্বের আর্থিক বাজারগুলো উল্লেখযোগ্য পতনের সম্মুখীন হয়েছে। মার্কিন স্টক মার্কেটের মূল্য প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলার কমেছে এবং টেসলা, অ্যামাজন, অ্যাপল এবং এনভিডিয়ার মতো বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো বাণিজ্যিক উত্তেজনা এবং মার্কিন শিল্পের চীনা কাঁচামাল ও প্রযুক্তির উপর তীব্র নির্ভরতার মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতির নাজুকতা নির্দেশ করে।
বিশ্লেষকদের মতে, ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা বৃদ্ধি, একই সাথে চীন সফলভাবে বৈশ্বিক বাণিজ্যে ইউয়ানের ভূমিকা প্রসারিত করছে, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। যদিও ট্রাম্প আগের মেয়াদেও অনুরূপ শুল্ক আরোপ করেছিলেন এবং পরে পিছিয়ে গিয়েছিলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা, মার্কিন শিল্পের চীনা কাঁচামাল ও প্রযুক্তির উপর ব্যাপক নির্ভরতা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের ‘ইউয়ান-করণ’-এর ক্রমবর্ধমান প্রবণতা সহজে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে।
এদিকে, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং এমনকি কিছু ইউরোপীয় দেশও ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর উপায় খুঁজছে। ব্রিকস (BRICS) জোট তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে জাতীয় মুদ্রার ব্যবহার শক্তিশালীকরণ বা একটি সাধারণ মুদ্রা তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এই সমস্ত পদক্ষেপ একটি বহু-মেরু আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান ঘটানোর দিকে পরিচালিত হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে, গোল্ডম্যান স্যাক্সের পূর্বাভাস নির্দেশ করে যে, বিশ্ব অর্থনীতি একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করছে; এমন একটি পর্যায় যেখানে এশিয়া বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে।
যদিও ডলারের সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপনের জন্য এখনও একটি দীর্ঘ পথ বাকি আছে, তবুও বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন পথ শুরু হয়েছে এবং ডিডলারাইজেশনের রেলগাড়িটি একটি অদম্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। এই পথে, যেকোনো দেশই মার্কিন আর্থিক আধিপত্য থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাদেরকেও এতে যোগ দিতে হবে। বাস্তবে, বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যত এমন একটি মুদ্রার উপর নির্ভরশীল যা বলপ্রয়োগে নয়, বরং বিশ্বাসের ওপর নির্মিত হবে।

