আমরা এখন এমন সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন ডেটিং অ্যাপগুলোতে অপশনের শেষ নেই এবং সম্পর্কের ধরনও প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, মানুষ কি সত্যিই একগামী?

ইংরেজিতে ‘পলিয়্যামোরি’ নামক একটি শব্দ আছে, যা মূলত সম্পর্কের একটি ধরন। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি যদি একসাথে একাধিক প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখেন এবং সব পক্ষই বিষয়টি সম্বন্ধে জানেন ও রাজি থাকেন, তখন সেই সম্পর্ককে পলিয়্যামোরি হিসাবে সঙ্গায়িত করা হয়।
লন্ডনে বসবাসরত রোমানিয়ান নারী অ্যালাইনা যখন পলিয়্যামোরি সম্বন্ধে জানতে পারেন, তখন তিনি নিজেকে ঠিক ওই প্রশ্নই করেছিলেন যে মানুষ আসলেই একগামী কিনা।
তিনি বলেন, “আমি সম্প্রতি এমন একজনের সঙ্গে দেখা করেছি, যিনি সবসময়ই পলিয়্যামোরাস ছিলেন। তখনই আমার মনে প্রশ্ন আসে, সমাজ কেন একগামিতাকেই আদর্শ ধরেছে?”
মানুষের বিবর্তনের গতিপথ বোঝার একটি উপায় হলো, আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রজাতি বানরজাতীয় প্রাণির বংশবৃদ্ধির পদ্ধতিগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা।
যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির এভোলিউশনারি বায়োলজিস্ট বা বিবর্তনবিদ কিট ওপি জানান, “গরিলারা বহুগামী। একটি পুরুষ গরিলা একাধিক নারী গরিলার সাথে মিলিত হয়।”
কিন্তু বংশবৃদ্ধির এই পদ্ধতি খুব একটা কার্যকর নয়। কারণ এমন ব্যবস্থায় অনেক সময় নবজাতককে মেরে ফেলার মতো নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে, উল্লেখ করেন ড. অপি।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, “নবজাতক হত্যা গরিলা সমাজের ভয়াবহ একটি দিক।”
“একটি পুরুষ গরিলা যখন দেখে যে কোনও শাবক তার নিজের না, তখন সে সেই শাবককে মেরে ফেলে, যেন শাবকের মা দ্রুত প্রজননে সক্ষম হয় এবং সে তার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। এই প্রজনন কৌশল নিশ্চয়ই আমরা আমাদের সমাজে অনুকরণ করতে চাই,” তিনি যোগ করেন।
তবে মানবজাতির কাছাকাছি আরও কিছু প্রাইমেট, যেমন‒ নারী শিম্পাঞ্জি ও বোনোবো আবার প্রজননের ক্ষেত্রে অন্য কৌশল অনুসরণ করে। তারা বহু পুরুষের সাথে মিলিত হয়, যার ফলে বাবার সঠিক পরিচয় জানা যায় না এবং শাবকদের ওপর আক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়।
মানুষের সমাজেও সম্ভবত এই ধরনের মিলন ব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল, যেখানে নারী ও পুরুষ, উভয়ই একাধিক মানুষের সঙ্গে মিলিত হতো। তবে প্রায় ২০ লাখ বছর আগে “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে” এখানে বড় এক পরিবর্তন আসে বলে জানান ড. অপি।
কিট ওপি বলেন, “আফ্রিকা মহাদেশের সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে আমাদের পূর্বপুরুষরা বসবাস করতো। সেখানে তখন ভয়াবহ খরা দেখা দেয়। যার ফলে ঘন জঙ্গল হারিয়ে গিয়ে ওই পুরো অঞ্চুল তৃণভূমিতে (সাভান্না) রূপ নেয়। ওই সময় মানুষকে শিকারি পশুদের হাত থেকে বেঁচে থাকার জন্য বৃহৎ আকারে দলবদ্ধভাবে থাকতে হতো। এই জটিল সামাজিক কাঠামো সামলাতে মানুষের মস্তিষ্ক বড় হয়। আর সেই মস্তিষ্ক পুষ্ট রাখতে শিশুদের স্তন্যপানকাল দীর্ঘ হয়।”
একগামিতা কি আদর্শ পন্থা?
কিন্তু একটি বড় দলে যেহেতু অনেক পুরুষ ছিল এবং নারীরা যেহেতু একাধিক পুরুষের সাথে মিলিত হত, তাই পিতৃপরিচয় নির্ধারণ করাটা তখন অনেক কঠিন বিষয় হয়ে ওঠে।
“তাছাড়া, এই সময় সন্তানকে বড় করে তোলার জন্য মায়েদের সহায়তা দরকার হয়, বিশেষত যেকোনও একজন পুরুষের। এবং, তখনই মানুষ একগামিতাকে বেছে নেয়।”
কিট ওপি’র মতে, একগামিতাই “শ্রেষ্ঠ”, এই ধারণা থেকে এই পরিবর্তন হয়নি। বরং, তখনকার বাস্তবতায় টিকে থাকার একমাত্র উপায় হিসাবে এটি আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো।
কারণ বড় মস্তিষ্ক ও ধীরে বেড়ে ওঠা মানব সন্তান পালনের জন্য বিপুল সময়, ভালোবাসা, নিরাপত্তা দরকার। একজন মায়ের পক্ষে একা সেটা সামলানো সবসময় সম্ভব নয়। এসব কারণেই তখন মায়েদের সহায়তা দরকার হয়, বিশেষত পুরুষের।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তবতার কারণে ওইসময় মানবজাতি একগামিতাকে বেছে নিলেও তারা একজন সঙ্গীর প্রতি পুরোপুরি অনুগত থাকতে প্রায়ই হিমশিম খেত।
ড. ওপি বলেন, “জীবনভর শুধু একজনের সাথেই থাকে ও সঙ্গীর সাথে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না, পৃথিবীতে এমন প্রজাতিও আছে। তবে তা বেশ বিরল।”
তার মতে, আমাদের সবচেয়ে কাছের একগামী প্রজাতি হলো গিবন। গিবন দম্পতিরা জঙ্গলের কোনও নির্দিষ্ট কোণে আলাদা আলাদাভাবে থাকে। তাদের সীমানায় কে ঢুকবে আর কে ঢুকবে না, তা নিয়ন্ত্রণ করাটা নারী ও পুরুষ গিবন, উভয়ের জন্যই সম্ভবত সহজ।
ভালোবাসার রসায়ন
বিবর্তনবিদ ড. কিট ওপি জানান, গিবনদের একেক জোড়া জঙ্গলের একেক জায়গায় একাকী বসবাস করে বলে সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকাটা তাদের জন্য তুলনামূলক সহজ কাজ।
“কিন্তু অনেক নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত বৃহৎ গোষ্ঠীতে মানুষের বসবাস। তাই এখানে কেউ তার সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত কিনা, তা নিয়ন্ত্রণ করাটা বেশ কঠিন।”
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, একগামিতা আসলে কোনও সহজাত বা স্বাভাবিক নিয়ম না, বরং বাঁচার একটি কৌশলমাত্র। এই ব্যবস্থাটিকে মানুষ সময়ের প্রয়োজনেই বেছে নিয়েছে।
তবে আমরা যখন প্রেমে পড়ি বা সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করি, তখন মস্তিষ্কে কী ঘটে?
যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্সের পিএইচডি শিক্ষার্থী সারাহ ব্লুমেনথাল ‘প্রেইরি ভোল’ নামক ছোট এক প্রাণির ওপর গবেষণা করছেন, যারা মানুষের মতোই একগামী।
ইঁদুরের মতো দেখতে এই ছোট প্রাণিদের মস্তিষ্কে অক্সিটোসিনের মাত্রা বেশি থাকে।
অক্সিটোসিনকে ‘কাডল হরমোন’ বলা হয়। এই হরমোন বন্ধন গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক সংস্পর্শ ও আবেগঘন মুহূর্তে এটি নিঃসৃত হয়।
সারাহ ব্লুমেনথাল বলেন, “যদি প্রেইরি ভোলের মস্তিস্কে যদি অক্সিটোসিন বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে তারা আর সঙ্গীর সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে জড়াতে পারে না এবং সঙ্গীর সাথে কম সময় কাটায়।”
মানুষের মস্তিষ্কও এই নিয়মে পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে ডোপামিন নামক হরমোন। নতুন কিছুর প্রতি আকর্ষণ এবং পুরনো সম্পর্কে ক্লান্তির জন্য এটিই দায়ী।
সম্পর্কের শুরুর দিকে এই ডোপানিন হরমোনটিই সঙ্গীর প্রতি আকর্ষণ বাড়ায় এবং সম্পর্ক যখন পুরনো হয়ে যায়, তখন ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রায় বদল আসে।
মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা কমে গেলে সঙ্গীর প্রতি প্রতিশ্রুতি ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়।
এক নারী ও একাধিক স্বামী
বিবর্তনের যুক্তি একগামিতার পক্ষে থাকলেও মানব সভ্যতায় সবসময়ই সম্পর্কের নানা ধরন পরিলক্ষিত হয়েছে। যেমন, একগামিতা ছাড়াও সমাজে বহু বিবাহ বা বহুগামিতা, কিংবা পলিয়্যান্ড্রি সম্পর্ক রয়েছে। পলিয়্যান্ড্রি মানে হলো, একজন নারীর একাধিক স্বামী থাকা।
পৃথিবীতে এখনও পলিয়্যান্ড্রি সম্পর্কের প্রচলন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়েসের নৃতত্ত্ববিদ কেটি স্টার্কওয়েদার পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অন্তত ৫০টির মতো পলিয়্যান্ড্রি’র নজির খুঁজে পেয়েছেন। এই তালিকায় যেমন এশিয়ার নেপাল ও তিব্বত রয়েছে, ঠিক তেমনি আবার আফ্রিকা ও আমেরিকার অনেক অঞ্চলও রয়েছে।
যদিও পরিসংখ্যানের দিক থেকে পলিজিনি’র (একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী) তুলনায় বিশ্বব্যাপী পলিয়্যান্ড্রি’র সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবে এটিকে অসম্ভব বলে মনে করা উচিত না বলে মত তার।
তিনি বলেন, “একজন নারী একাধিক সঙ্গীর থেকে আর্থিকভাবে উপকৃত হতে পারেন। তার মূল স্বামী মারা গেলে বা দীর্ঘদিন দূরে থাকলে (ন্যাটিভ আমেরিকান গোষ্ঠীতে এটি দেখা যেত) নারীর টিকে থাকার জন্য তখন বিকল্প দরকার হতো।”
এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে বহুগামী সম্পর্ক জিনগত দিক থেকেও উপকারী হতে পারে।
কেটি স্টার্কওয়েদারের ব্যাখ্যা হলো, যেসব স্থানে মানুষ বেশি অসুস্থ হয় বা নানা রোগে মারা যায়, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন পুরুষের সঙ্গে সন্তানের জন্ম দেওয়া উপকারী হতে পারে। কারণ, এতে প্রতিটি সন্তানের জেনেটিক তথা জীনগত বৈচিত্র্য থাকে। ফলে, তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা পরস্পরের থেকে আলাদা হতে পারে।
“তখন কেউ না কেউ হয়তো সেই কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে,” বলেন তিনি।
পলিয়্যামোরি বনাম বাস্তবতা
পলিয়্যামোরিকে বাংলায় বহুপ্রেম বা একপ্রকার বহুগামিতা বলা যেতে পারে। তবে বহুগামী হওয়া মানেই যে সব কিছু সহজ, তা নয়। সম্মতির ভিত্তিতে হলেও একই সময়ে একাধিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে অনেক সময়, মানসিক শক্তি ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন হয়।
নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই একাধিক সম্পর্ক ধরে রাখা প্রচণ্ড পরিশ্রমসাধ্য। এটি মানসিকভাবে তো বটেই, অর্থনৈতিকভাবেও বেশ কঠিন। কারণ একাধিক সম্পর্ক মানে একাধিক দায়িত্ব।
কেটি স্টার্কওয়েদারের মতে, “পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনও একগামী সম্পর্কই বিয়েতে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আমার মনে হয় এটিই এগুলোর প্রধান কারণ।”
অ্যালাইনার ক্ষেত্রে তার আগের একগামী সম্পর্কগুলো ভালোভাবে কাজ করেনি। তাই, তিনি এখন সম্মতির ভিত্তিতে পলিয়্যামোরাস সম্পর্কের মধ্যে আছেন। তবে এখানে তাকে বেশ জটিল ও মিশ্র আবেগের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, “হিংসা খুব কঠিন এবং শক্তিশালী অনুভূতি। আমার ক্ষেত্রে এটি তখন কাজ করে, যখন দেখি যে আমার সাথে আমার সঙ্গী সত্য বলছে না। যখন আমি দেখি যে তারা আমার সাথে সত্য বলছেন, তখন আমার ভেতরে আর হিংসা কাজ করে না।”
তার সঙ্গী বলেন, “হিংসা অতটাও বড় সমস্যা নয়। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো একাধিক স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য অনেক বেশি সময় ও শক্তি লাগে।”
তবে তারা দু’জনেই একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন যে খোলামেলা আলাপে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে।
এবার প্রশ্ন হলো এই যে আমরা কি সহজাতভাবেই একগামী? এর উত্তর হলো, হ্যাঁ-না দু’টোই।
মানুষ সামাজিক জীব। আর তাদের সম্পর্কের ধরন নির্ভর করে সমাজ, পরিবেশ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার ওপর। কারও জন্য পলিয়্যামোরি মানে স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক সুযোগ।
আবার অনেকের জন্য সবচেয়ে সহজ ও স্থিতিশীল সম্পর্ক হলো একগামিতা।
কেটি স্টার্কওয়েদার বলেন, “মানুষ বিবর্তিত হয়েছে নমনীয় হওয়ার জন্য। আর এই নমনীয়তাই আমাদের সম্পর্কের কাঠামোতেও প্রতিফলিত হয়। বিশ্বের নানা পরিবেশে আমরা টিকে আছি এই নমনীয়তা আর আচরণগত অভিযোজনের কারণেই।” -বিবিসি বাংলা