সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সহিংস ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকা অনেকে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বা সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার দিকে জোর দিচ্ছেন। এতে রাজধানীসহ সারা দেশে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করার চাহিদা বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, গত এক বছরে এই বিক্রির হার দ্বিগুণ হয়েছে। তবে গত দুই সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। ঢাকায় বেশ কয়েকবছর ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ভবন, সরকারি বেসরকারি অফিস বা ব্যাংকে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি আবাসিক ভবনগুলোর পাশাপাশি অনেক এলাকার সমিতিগুলোর উদ্যোগে রাস্তাতেও ক্যামেরা বসানো হচ্ছে।
তবে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে নির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা বিধি নেই। কয়েক বছর আগে সব বহুতল ভবনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য পুলিশ নাগরিকদের অনুরোধ জানিয়েছিল। তবে বিষয়টি পুরোপুরি ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। এখন ঢাকায় কত ভবনে এরকম ক্যামেরা রয়েছে, সেই তথ্যও নেই কারো কাছে। এ জাতীয় সরঞ্জাম বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গত কয়েক মাসে এ জাতীয় পণ্যের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়েছে।
শাহেদ হোসেন নামের একজন বিক্রেতা বলছেন, ‘‘আগের তুলনায় ইদানীং আমাদের বিক্রি ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে মানুষজন নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। আবার এ জাতীয় সরঞ্জামের দামও এখন অনেক কম। তাই অনেকেই নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা কিনছেন।’’
তিনি জানান, বাণিজ্যিক ভবন বা অফিসের বাইরেও, আবাসিক ভবনগুলোর জন্যও অনেক ক্যামেরা বিক্রি হচ্ছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও এই প্রবণতা বাড়ছে। তাদের মোট ক্রেতাদের ৬০ শতাংশই ঢাকার বাইরের। এসব ক্যামেরায় টানা তিনমাস পর্যন্ত ভিডিও সংরক্ষণ করা যায়। চাহিদা অনুযায়ী দাম ওঠানামা করলেও, তা খুব বেশি নয়।
ব্যক্তি পর্যায়ে নিরাপত্তার স্বার্থে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার দিকে ঝুঁকছে সচ্ছল মানুষ। বাসা বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠায় চাহিদাও বেড়েছে। আর এ সুযোগে বাজারে আসছে নিম্নমানের ক্যামেরা। কম দাম হওয়ায় এবং ক্যামেরার ব্যাপারে ধারণা না থাকায় অনেকেই সেগুলো কিনে স্থাপন করছে। নিম্নমানের ক্যামেরাগুলোর রেজুলেশন এতই কম যে সেগুলো দিয়ে ধারণ করা ছবি অস্পষ্ট, যা পরে কাজে আসবে না বলেই মত দিয়েছেন নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, উন্নতমানের সিসি ক্যামেরা না হলে লক্ষ্যই ভেস্তে যাবে। ধরা- ছোঁয়ার বাইরে থাকবে অপরাধীরা।
ডিএমপির উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীরা অপকর্মের জন্য অন্ধকারটাকে বেছে নেয়। তাই সিসি ক্যামেরা ভালো মানের এবং নাইটভিশন (রাতের চিত্রধারণের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত) হতে হবে। আর সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম-নীতি ও মনিটরিং না থাকায় চীন থেকে গণহারে আনা হচ্ছে নিম্নমানের সি সি ক্যামেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, মানুষের নিরাপত্তা শুধু প্রশাসন দিয়ে নিশ্চিত করা যায় না। নাগরিকদের বোঝাতে হবে নিজের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের পাশাপাশি নিজেকেও সচেষ্ট হতে হবে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে সচেতন হলেই কেবল নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বৃদ্ধি মানে মানুষ নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন হচ্ছে। সরকারকে উচিত এ ব্যাপারগুলোকে উত্সাহ দেয়া। প্রয়োজনে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে এ ব্যাপারে ক্যাম্পেইন করা।
সিসি ক্যামেরার প্রযুক্তি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা জানান, নিরাপত্তার জন্য দুই ধরনের সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এইচডি (হাই ডেফিনেশন) সিসি ক্যামেরা অপরটি নন এইচডি অর্থাত্ সাধারণ মানের সিসি ক্যামেরা। সাধারণ মানের ক্যামেরা দিয়ে ক্যামেরার সামনের ১০ থেকে ২০ মিটার দূরত্বের চিত্রধারণ সম্ভব। আর এইচডি (হাই ডেফিনেশন) মানের ক্যামেরা দিয়ে ৩০ থেকে ৭০ মিটার দূরত্বের চিত্র ধারণ করা যায়। এইচডি ক্যামেরায় মুভি ক্লিয়ার (স্পষ্ট চিত্র) হয়।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি মার্কেটের ব্যবসায়ী মো. জাবেদ বলেন, সাধারণ সিসি ক্যামেরা আড়াই হাজার থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। অপর দিকে ৭ থেকে ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে এইচডি (হাই ডেফিনেশন) সিসি ক্যামেরা। বাসা বাড়ি, অফিস ও দোকানের জন্য এইচডি সিসি ক্যামেরার পুরো প্যাকেজের খরচ এখন ৪৫ হাজার টাকার মধ্যে। আর অ্যানালগ ক্যামেরার খরচ ২০ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে।
এ বিষয়ে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা তানভীরুল ইসলাম বলেন, ‘নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখন প্রায় সবাই সিসি ক্যামেরা লাগানোর বিষয়ে আমাদের বলছেন। এ ছাড়া ভিডিও ডোর কলের মাধ্যমে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি বাসায় যাবে কি না, তা দেখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সাধারণত আমরা ছাদের রেলিং, পার্কিং ও বাসার প্রবেশমুখে বেশি করে সিসি ক্যামেরা লাগানোর অর্ডার পাচ্ছি।’ দিনে দিনে এভাবে ক্যামেরার ব্যবহার বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাসে নিজের বাসায় খুন হন ইউএসএআইডি’র কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়। এরপর লেক সার্কাসের ডলফিন গলি দিয়ে পালিয়ে যায় ঘাতকরা। তাদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ধারণ হয় পাশের বাড়ির সিসি ক্যামেরায়। এছাড়া, ডাকাতি ও খুনসহ বিভিন্ন ঘটনায় অপরাধীদের শনাক্ত করতে ঘটনাস্থল বা ঘটনাস্থলের আশেপাশের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজের সহায়তা নেয় পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে এসব ফুটেজ দেখেই অপারাধীদের শনাক্ত করতেও সক্ষম হচ্ছে প্রশাসন।
২০১৫ সালের বাংলা নববর্ষের দিনে নারী লাঞ্চনাকারীদের সিসি ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও ক্যামেরার মান খারাপ হওয়ায় তাদের চেহারা অস্পষ্ট ছিল। বিভিন্ন দোকানে সিসিটিভির মাধ্যমে চোর শনাক্ত করা যাচ্ছে। এটিএম বুথে টাকা হ্যাকিংয়ের ঘটনায় বিদেশীকে একই পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। চলচ্চিত্র পরিচালক খালিদ মাহমুদ মিঠুর মাথায় গাছ পড়ে নিহতের দৃশ্য সিসিটিভির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এ সম্পর্কে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম (বীর প্রতীক) বলেন, ‘একদিকে দেশের জনসংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। অপরদিকে দেশের গোয়েন্দাদের সংখ্যা সীমিত। সিসি ক্যামেরার ব্যবহার গোয়েন্দা সংস্থার সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। নিরাপত্তা ইস্যুতে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার বাড়ছে তা ভালো দিক।’ তবে এটার সুফল পেতে হলে সিসি ক্যামেরার গুণগত মান ও জালিয়াতির হাত থেকে মুক্ত রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সরেজমিনে রাজধানীর স্টেডিয়াম, বসুন্ধরা সিটি, এলিফ্যান্ট রোড, বায়তুল মোকারম মার্কেটে গিয়ে দেখা গেছে, সিসি ক্যামেরার দোকানগুলোতে ক্রেতারা ভীড় করছে। একই সঙ্গে তারা ভালো মন্দ যাচাই বাছাই করছে। কেউ কেউ ক্যামেরার টুকিটাকি সমস্যা সমাধানের জন্য আসছে।
সিসি ক্যামেরা আমদানিকারক ক্যামেরা ভিশনের স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুস সালাম জানান, ‘আগে ক্যমেরা বিক্রি করার জন্য কর্মচারীরা মার্কেটিং করতো। তবুও সিসি ক্যামেরা বসানোর আগ্রহ দেখা যেতো না। কিন্তু কিছুদিন আগে দু’জন বিদেশি নাগরিক, ব্লগার, প্রকাশক হ্ত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। নিরাপত্তা নজরদারি বাড়াতে এখন ব্যক্তিগতভাবে অনেকে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।’ এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নজরদারীর জন্যও এর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তিনি।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও স্টেডিয়াম মার্কেটে দেশের সবচেয়ে বড় সিসি ক্যামেরার বাজার। এর বাইরে ধানমন্ডি, বনানী, কম্পিউটার সিটিসহ বড় বড় কয়েকটি শপিং সেন্টারে সিসি ক্যামেরার মার্কেট আছে। ক্যামেরা ভিশনের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম জানান, আগে দিনে সিসি ক্যামেরা বসাবে এমন একজন পার্টি পাওয়া যেতো না। এখন দিনে দুএকটি ক্যামেরা ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্ডার রয়েছেই। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার দুদিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১৫০টি ক্যামেরা স্থাপন করেছি।’জানা গেছে, ক্যামেরার দাম নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর। এর মধ্যে ক্যামেরার গুণগত মান, লেন্স এবং প্রস্তুতকারী কোম্পানির টেকসই নিশ্চয়তার উপর ক্যামেরার দাম নির্ভর করে। বাজারে চায়নার ডব্লিউএনটি, ইয়াডো, কুরিয়ার কেমটেক্স, তাইওয়ানের কেমপ্রো বেশি চলছে। কোম্পানি ও মানভেদে প্রতিটি ক্যামেরা সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।ক্যামেরা জোনের স্বত্ত্বাধিকারী মাসুদ জানান, একটি ক্যামেরা স্থাপন করে নিরাপত্তা নজরদারি করতে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা খরচ পড়বে (রেকর্ডিং ছাড়া) । আর যদি কেউ এক মাস পর্যন্ত ভিডিও রেকর্ড রাখতে চায় তাহলে খরচ পড়বে ১৫ হাজার টাকা।
রাজধানীর কচুক্ষেত থেকে বায়তুল মোকাররমে সিসি ক্যামেরা কিনতে আসা আব্দুল আলিম বলেন, পরিস্থিতি খুব বেশি ভালো না। বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পরে সন্ত্রাসীরা। সিসি ক্যামেরা থাকলে দেখে-শুনে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বাড়তি খরচ হলেও নিরাপত্তার জন্য এছাড়া উপায় নেই।