মো. আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায় :: বর্তমানে বাংলাদেশের সকল কিছুর সঙ্গেই ডিজিটাল বাংলাদেশ। কেউ কেউ একে ব্যঙ্গও করেন। তাদের কাছে হতাশার নাম ডিজিটাল বাংলাদেশ। কেউ কেউ এমনটি বলেন, বাতি জ্বালানোর বিদ্যুৎ যেখানে পাওয়া যায় না সেখানে আবার ডিজিটাল বাংলাদেশ। যেখানে আশাবাদ থাকে সেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তরুণদের মাঝে এই স্বপ্নটা অনেক বড়। সরকারের সকল পর্যায়ে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা অবিরাম বলতে থাকার ফলে এখন বাংলাদেশের রাজনীতির মাঝেও সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দটি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। বাণিজ্য ও সমাজ দুদিকে এর প্রভাব তীব্র। এর প্রভাবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করার সুযোগ সম্বলিত বিজ্ঞাপনেও ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি। আমাদের পরিস্কার দুই ধারা এনালগ না ডিজিটাল।
সাধারণভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে অনেকেই সর্বত্র কম্পিউটার ব্যবহারকে মনে করেন। ‘ ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচনসহ সব প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে প্রযুক্তির লাগসই প্রয়োগের একটি আধুনিক দর্শন। সর্বত্র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং সর্বোপরি সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সুখী সমৃদ্ধ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বাংলাদেশ এবং চালিকাশক্তি হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। বর্তমান সরকার রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলতে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রসমূহের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি ও সমন্বয় সাধন করে চলার যোগ্যতা অর্জনকে বুঝায়। পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনকে স্বাগতম জানানো।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বলতে যত সহজ মনে হয় আসলে তা বাস্তবায়ন করা তত কঠিন। কিন্তু তাই বলে তা অসম্ভবও নয়। আমাদের দেশের ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামের মানুষেরা শহরের মানুষের চেয়ে অনেক কম সুযোগ সুবিধা পায়। শুধু শহরের নাগরিকদের কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সুবিধা দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে দিতে হবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা। পরিবর্তন করতে হবে গ্রামের জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান। নিশ্চিত করতে হবে তাদের স্বাস্থ্য সেবা, ছড়িয়ে দিতে হবে শিক্ষার আলো, উন্নত করতে হবে যোগাযোগের ব্যবস্থা। এ কাজগুলো করতে পারলেই আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। দেশের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। তাই উন্নয়ন এবং আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কৃষি উন্নয়ন ও বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন কৃষিশিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ এবং ব্যবহারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। কৃষি উন্নয়ন বলতে বোঝায় দেশের শস্য, পশুসম্পদ, মৎস্যসম্পদ ও বনসম্পদের পরিকল্পিত উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা।
অথচ কৃষি খাতে এখনো মান্ধাতা আমলের কৃষি ও সেচকার্য চলছে। কৃষি খাত সম্মিলিতভাবে যান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করতে পারেনি। কৃষিকে যদি ডিজিটাল পর্যায়ে নিয়ে না আসা যায় তাহলে ২০২১ সালে ডিজিটাল শব্দটি স্লোগানধর্মী শব্দ হিসেবেই থেকে যাবে। তৃণমূলে কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, বনবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ পৌঁছাতে পারলে ডিজিটাল কৃষির অগ্রগতি একধাপ এগিয়ে যাবে।
বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে বলেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে ঠিকমতো কাজ করছেন না আমলারা। এই আমলাদের দিয়ে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করা যাবে না। আমলাদের বেশিরভাগই তথ্যপ্রযুক্তি সর্ম্পকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখেন না। এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান ভাসা ভাসা। এই ভাসা ভাসা জ্ঞান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাইপ করা, কম্পিউটারে গান শোনা বা ছবি দেখার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
তথ্যপ্রযুুক্তিতে অজ্ঞ লোক দিয়ে বাংলাদেশকে ডিজিটাল করা যাবে, সরকার এমনটা ভেবে থাকলে বলতে হবে তারা ভুল করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে তার পরিকল্পনার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিতে জ্ঞানী, দক্ষ, অভিজ্ঞ লোকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এ কাজে সম্পৃক্ত হতে তরুণ যুব সমাজকে বিশেষভাবে শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা। সারাদেশে ৪০-৬০ লক্ষ এস.এস.সি পাশ যুবক বেকার। অর্ধশিক্ষিত, কর্মহীন যুবকরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, পথে-ঘাটে, যানবাহনে, পাড়া-মহল্লা, অলিতে গলিতে ইভটিজিং এ জড়িয়ে পড়ছে। স্কুল জীবনে এইসব তরুণদের স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। শিক্ষা সমাপ্তির পর নিজ পরিবার, সমাজ, দেশের জন্য কর্ম সংযোগ করবে। আজ তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এর জন্য উপনিবেশীক আমলে গড়া কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী। রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। এই সব দিকনির্দেশনাহীন তরুণদের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রাথমিক ভিত রচনায় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
জ্ঞাননির্ভর এ প্রযুক্তিতে সাফল্য নিশ্চিত করতে হলে জ্ঞান বিতরণ ও সৃষ্টির উৎস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু, অগ্রপথিক। স্কুল কলেজের তরুণ ছাত্রছাত্রীদের ই-গর্ভনমেন্ট, ই-হেলথ, ই-লার্নিংসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার তৈরি, মোবাইল তৈরি, শিপ তৈরি, শিপ চালনা, বিমান তৈরি, বিমান চালনা, সাবমেরিন তৈরি, নিউক্লিয়ার, মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ্যায় ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত তরুণদের এই সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির নানা আকর্ষণীয় পুরস্কার ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। লক্ষ লক্ষ ছাত্র তরুণের সৃজনশীলতা, মেধা ও দক্ষতা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠার উপযোগী ক্ষেত্র তৈরি হবে।
মো. আবুল হাসান, সভাপতি
খন রঞ্জন রায়, মহাসচিব
ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ।
৪৭, মতি টাওয়ার, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
০১৭১১ ১২২৪২৫, ০১৮২০ ১৩০০৯০
