সোনালী লতার কথা মনে পড়ছে খুব। গ্রামের ঝোপ-ঝাড়ের উপর খুব সুন্দর স্বর্ণের মতো রং এর লতায় জড়ানো থাকে। আমাদের বাড়িতে টয়লেটের দিকটায় ছিটকির ঝোপে সোনালী লতা হত। বর্ষা এলে পানিতে মরে যেত সব। আবার পানি চলে গেলে কি থেকে যে হতো। ছোটবেলায় আমার কাছে বড় আশ্চর্যের ছিল ব্যপারটি। সোনালী লতার কোনো শিকড় থাকে না। অন্য গাছের উপর পড়ে থেকেই বেঁচে থাকে। শিকড় ছাড়া সুন্দর এই লতানো ঝোপটি এমন করে গাছটাকে ঝাপটে ধরে যে ওই গাছটিরই আর অস্তিত্ব থাকে না। অনেক দিন পর ঢাকায় সোনালী লতা দেখলাম সেদিন হাতির ঝিলের রাস্তায় গুলশানের কাছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা ওগুলোকে টেনে টেনে তুলে ফেলছে। কারণ সৌন্দর্য্য বর্ধণের জন্য যে গাছ লাগানো হয়েছে সেগুলোকে মেরে ফেলছে সোনালী লতা। এই লতার সাথে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির একটা মিল আছে। তারাও অন্য ঝোপ ঝাড়ের উপর ভর করে।
দুই বার জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করা দলটির কর্মকান্ড দেখে মনে হয়েছে বিএনপি দেউলিয়া হয়ে গেছে। নিজেদের শক্তি সামর্থ, সাহস, জনমর্থন কিছুই নেই। তারা হয়ত ভুলেই গেছে ভয়াবহ খরার ২০০৮ সালের নির্বাচনে তারা ৩২ শতাংশের উপর ভোট পেয়েছে। বিএনপি জামায়াত মিলিয়ে ৩৭ শতাংশ।
শুরু থেকেই তারা জামায়াতের উপর ভর করে ছিল। এরপর এল গণজাগরণ মঞ্চ। তাদের ভর করার চেষ্টা করলো দলটি। ঢাকা মহানগররে আহ্বাবায়ক সাদেক হোসেন খোকা বললেন, “ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চ যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, আ্ওয়ামী লীগ সরকারের দূর্ণীতির বিষয়গুলো তুলে ধরে। তাহলেই বিএনপি গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন দেবে” , জাগরণ মঞ্চ প্রত্যাখান করলো। বিএনপি শুরু করলো তরুণদের বিরুদ্ধে কুৎসা, কুরটনা।
এর আগে ভর করার চেষ্টা করেছিল সেনা বাহিনীর উপর। বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়া এক জনসভায় আহ্বান জানালেন, সেনা বাহিনীকে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে”, সবাই সমালোচনা করলেন বেগম জিয়ার এ ধরণের আহ্বান জানানোকে। অবাক হলেন, জণগণের উপর আস্থা না রেখে কেন সুশৃংখল সেনা বাহিনীর উপর ভর করার চেষ্টা করছেন।
সেনা বাহিনীর উপর ভর করা বিএনপির জন্মের স্বভাব। এখন চলে যেতে হয় দলটির ইতিহাসে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করা হল। জিয়াউর রহমান তখন ভর করেছিলেন, খুনী ডালিম, রশিদদের উপর। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা জুনিয়র অফিসার, তোমরা এসব করতে পারো,” তাই বঙ্গবন্ধুর খুন হওয়ার খবর শুনে তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট মারা গেছে সো হুোয়াট?” পুরো বিয়ষটি তিনি জানতেন। তিনি হলেন ঘটনার সুবিধা ভোগীদের অন্যতম। কয়েক দিন পরেই ডালিম, রশিদের লবিং এ তিনি হলেন সেনা প্রধান। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের খালেদ মোশাররফের বিপ্লবে আটক হলেন, জিয়াউর রহমান। তখন জিয়াউর রহমান ভর করলেন কর্ণেল তাহেরের উপর। ৭ নভেম্বরের বিপ্লব হলো। মুক্ত হলেন জিয়াউর রহমান। রাষ্ট্রপতি হলেন তিনি। পরে অবশ্য রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে খুন করা হয় বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহেরকে।
সব শেষ আমরা দেখলাম, হেফাজত ইসলামের নামের সংগঠটির উপর ভর করতে। হঠাৎ করেই ৪ মে সামাবেশ ডেকে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে গণজাগরণ মঞ্চের দেখানো পথে টানা অবস্থান কর্মসূচির হুমকী দিলেন । ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলে সে ধরণের কর্মসূচি হবে সেটা মোটামুটি চূড়ান্ত জেনে গোলো বিএনপি নেতাকর্মীরা। কিন্তু তার পর দিনই ফ্লাসফেমী আইন করাসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজত ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি। ৬টি পয়েন্টে অবস্থান নিলেন হেফাজত কর্মীরা। দুপুরের মধ্যে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট শুরু করলো, হেফাজত, জামায়াত, বিএনপি কর্মীরা।
গত ৬ এপ্রিল প্রথম সমাবেশেই হেফাজত নেতারা যেন রাজধানীতে টানা অবস্থান নেয় তার পরিকল্পনা করে রেখেছিল বিএনপি। কিন্তু ঠিক মতো ভর করতে পরেনি বিএনপি। বিএনপির আছর ছেড়ে হেফাজত বেড়িয়ে গোলো। ঢাকা ছেড়ে চলে যায় তারা। কিন্তু এবার পারেনি। তারা বসে পড়লেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠক করলো সন্ধ্যায় নয়া পল্টন কার্যালয়ে। ঘোষণা দিলেন, হেফাজতে নেতাদের অবস্থান কর্মসূচিতে সহায়তা করো। চিড়া, মুড়ি, কলা নিয়ে যাও মুসাফিরদের জন্য। রাত টুকু পার হলেই ৪৮ ঘন্টা আল্টিমেটা শেষ হয়ে যায়। তারপর হেফাজতের কাঁধে পা রেখে অরাজকতা তৈরী করা, সরকারে বেকায়দায় ফেলা, প্রয়োজনে সরকার পতন।
কিন্তু এবার সে স্বপ্ন দূ:স্বপ্ন হলো। সব রাতের মতো সে দিন ভোর রাতেও ঘুমতে যেতে পারলেনা খালেদা জিয়া। কারণ মধ্য রাতের পর র্যাব, পুলিশ, বিজিবরি বুদ্ধিদৃপ্ত অভিযান শেষ হয় ভোর রাতে। উঠিয়ে দেয়া হয় হেফাজত কর্মীদের অবস্থঅন থেকে। তাই বিএনপির হা হুতাশ। এতো গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেলের শব্দ শুনলাম লাশ কই? তাইলে লাশ গুম হয়েছে।গুজব ছড়াতে লাগলেন তারা। সাদেক হোসেন খোকার অভিযোগ “হাজার হাজার লাশ গুম হয়েছে” আল জাজিরার বরাত দিয়ে। আমরা কেউই অবশ্য আল জাজিরাতে সেই নিউজ খুঁজে পেলাম না। দুই দিনে সারা দেশে হেফাজত পুলিশ সংঘর্ষে ৩৭ জন নিহত। এদের মধ্যে পুলিশ, বিজিবি চার জন।
অনেক সাংবাদিক ছিল রাতে সেখানে। বিএনপি সমর্থক এমনকি শিবির কর্মী বলে পরিচিত সাংবাদিকদের কেউ লাশ দেখেনি অভিযানে। সাদেক হোসেন খোকার টিলিভিশন, বাংলা ভিশন, কিংবা বিএনপির নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর এনটিভি দেখাতে পারনি। টিভি গুলো সরকারের ভয়ে লাশ দেখাতে নি বলেও বলছে তারা। তাহলে বিএনপি ফুটেজ গুলো প্রজেক্টরের মাধ্যমে দেশের মানুষকে দেখাক। তবুও নাকি লাশ গুম হয়ছে বলে বিএনপির দাবি। এখন তারা ভর করছে মিথ্যার উপর।
আন্দোলনের সাথে যদি সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত থাকে অনেক লাশ লাগে না। ৫২ ফেব্রুয়ারীতে ৭/৮ জন মারা গেছে বলে পর দিন ইত্তেফাক পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। বাঙ্গালীর বাংলা ভাষার দাবি ঠেকে থাকেনি। ৬৯ এ এক আসাদ মারা গেছে, তাতেই পাকিস্তানী সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যত্থান হয়েছে। তাই বিএনপির কেন হাজার হাজার মিথ্যা লাশের উপর ভর করতে হয় এটাই বুঝি না?
লেখক : একাত্তর টিভি’র স্টাফ রিপোর্টার
No Comments
dosto khub valo & sothik itihas lekheso, puro lekhata darun hoyese, i m fully agree with u.
দোস্ত খুব ভাল এবং যুক্তিসঙ্গত লেখা হয়েছে ৷ আমি তোর সাথে সহমত প্রকাশ করছি ৷