জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হতে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের দায় নেই বললেই চলে। দায় না থাকলেও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অঙ্গীকার এরই মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদের বাসিন্দারা যে ক্ষতির শিকার হচ্ছে সেই ক্ষতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অভিযোজনের কোনো বিকল্প নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের লাখো-কোটি মানুষ ‘নিষ্পাপ ভিক্টিম’ হচ্ছে। ক্ষতির শিকার হচ্ছে পুরো রাষ্ট্রই। অর্থনৈতিক, পারিপার্শ্বিক, সামাজিকসহ এমন কোনো দিক নেই যে ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব নেই। কারণ প্রত্যেকটি বিষয়ই আন্তঃসম্পর্কিত। তাই অনাকাক্সিক্ষত এই ক্ষতি কমিয়ে আনতে উন্নত দেশগুলোর দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
উইকিপিডিয়ার মতে, জলবায়ু হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়া। বর্তমান বিশ্বে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এটি বৈশ্বিক উষ্ণতা নামে পরিচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কারণ রয়েছে। কিছু রয়েছে প্রাকৃতিক কারণ। আর বাকিগুলো মূলত মনুষ্যসৃষ্ট বলেই ধরে নেওয়া হয়। বিশেষ করে, উন্নয়ন কর্মকা- এবং আধুনিক ও ভারি যন্ত্রপাতির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে। আর তা প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটাতে। পরিবেশ দূষণসহ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বড় বড় কলকারখানা আর তথাকথিত উন্নয়নযজ্ঞ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এরই মধ্যে বেশ প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে প্রকৃতিতে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতিবৃষ্টিসহ নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যস্ত করে তুলেছে মানুষের জীবন। গড় তাপমাত্রা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে সামনের দিনগুলোতে জনজীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা না গেলে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপর্যয়। বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটি বিশাল এক হুমকি। কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে বাংলাদেশের মতো এতো বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশকে পড়তে হবে নতুন সংকটে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখার ক্ষেত্রে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২১) যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ক্লাইমেট ট্র্যাকার’ প্যারিস সম্মেলনের চুক্তি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি মনে করে, যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে করে পরিবেশে এরই মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সেজন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারের মাত্রা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার ১.৫ ডিগ্রি নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় অভিযোজন কার্যক্রমের দিকে জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে ক্লাইমেট এনালিটিক্স সবিস্তারে যুক্তিগুলো তুলে ধরেছে তাদের ওয়েবসাইটে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘকে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন ও কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে প্রচুর টাকা প্রয়োজন। ২০১৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলার লাগবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ। আর ১০টি খাতে অভিযোজন বাবদ লাগবে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ অভিযোজনের বিষয়টিকে এরই মধ্যে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ক্ষেত্রে নিজস্ব সম্পদ ব্যয়ের অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশ সর্বমোট ২০ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ বলেছে, আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রাপ্তি সাপেক্ষে এই হার আরও ১৫ শতাংশ বাড়ানো হবে। প্যারিস সম্মেলনের আগে জাতিসংঘকে দেওয়া কার্বন নিসঃরণের লক্ষ্যমাত্রা বিষয়ক প্রতিবেদনে (আইএনডিসি) বাংলাদেশ জানায়, জ্বালানি, পরিবহন এবং শিল্প খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানো হবে।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু এরপরও কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার করার বিষয়টি বিশ্ববাসী তথা উন্নত দেশগুলোর জন্য একটা বড় উদাহরণ। বাংলাদেশ চায় এর ফলে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোও যেন কার্বন নিসঃরণ কমানোর ব্যাপারে এগিয়ে আসে।
জানা গেছে, জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনইপি-এর সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৯টি যে অঙ্গীকার করেছে তা যদি পুুরোপুরি বাস্তবায়িতও হয়, তারপরও বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ৩ দশমিক ৫ ডিগ্রির মতো বাড়বে। আর সেই রাষ্ট্রগুলো অঙ্গীকার বাস্তবায়ন না করলে তাপমাত্রা বাড়বে চার ডিগ্রিরও বেশি! ইউএনইপি ‘দ্য এমিশেন গ্যাপ-২০১৫’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ কথা জানায়। এই প্রতিবেদনই প্রমাণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামনের দিনগুলোতে কতটা ভয়াবহ হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই হার সারা বিশ্বেই দুর্যোগ ব্যাপক হাবে বাড়াবে। সেই সঙ্গে উচ্চতা বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের। এর ফলে বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তনসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানান সংকট দেখা দেবে। ইউএনইপি মনে করে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে বিশ্বের প্রায় ৮ কোটি উপকূলবাসীকে বসতভিটা হারাতে হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে কৃষি উৎপাদন। বাংলাদেশে বর্তমানের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ আর সম্ভব হবে না। ধানগাছের ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে কিংবা খুব কম তাপমাত্রায় অর্থাৎ ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এলে শীষে ধানের সংখ্যা অনেক কমে যাবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিভাগের উপপরিচালক ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার তার একটি নিবন্ধে বলেন, ২০০০ সনে প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে কক্সবাজার উপকূলে বছরে ৭ দশমিক ৮ মিলিমিটার হারে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। গত চার দশকে ভোলার প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার উঁচু হতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের মোট আয়তনের শতকরা ১৮ দশমিক ৩ ভাগ নিমজ্জিত হতে পারে। আর এর সবই হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল। এতে করে কৃষি-ব্যবস্থা ও উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য, অভিযোজন বিভিন্ন কলাকৌশল বিশেষভাবে রপ্ত করতে হবে, যাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁঁকি কমানো যায়। সেই সঙ্গে দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণসহ ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে যাতে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মানওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বেশিরভাগই দরিদ্র। বাংলাদেশ ওই তালিকায় সব সময়ই প্রথম সারিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের একটি তালিকা দেওয়া হয় গত বছর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৯ বছরের মধ্যে ক্ষতির শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফিলিপাইন। ওই দেশটিতে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। ফিলিপাইনে ১৯ বছরে ৩২৮টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর পরেই আছে বাংলাদেশের নাম। ২২৮টি দুর্যোগ আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মোট ক্ষতি ও ঝুঁঁকির বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে হন্ডুরাস। আর বাংলাদেশের অবস্থান ৬ নম্বরে। ১৯ বছরে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আর মোট আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩১২ কোটি ৮০ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলারের। তাই সামনের দিনগুলোর এমন ক্ষতির হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হতে পারে অভিযোজন।
লেখক : বার্তাবাংলা’র প্রধান সম্পাদক