তীব্র গরমের অসহনীয় কষ্ট এখন ঢাকাবাসীর নিত্যসঙ্গী। দিনে মাথার ওপর তপ্ত সূর্য আর রাতে ঘরের মধ্যে গরম বাতাসের ভ্যাপসা অনুভূতি। গত এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় যেখানে ৩৬ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস সেখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ২৮-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ রাত আর দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য মাত্র ৭ থেকে ৮ ডিগ্রি। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে রাজধানীতে কোথাও স্বস্তি নেই। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন না। দুপুরে অনেকটা ফাঁকা থাকছে রাজধানীর রাজপথ। রাতেও স্বস্তি নেই। সারাদিনের উত্তাপ কমতে কমতে অধিকাংশ এলাকায় শুরু হয় বিদ্যুতের লোডশেডিং। ফলে রাতও অস্বস্তি কাটাতে হচ্ছে নগরবাসীদের।
নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার বাংলাদেশে চৈত্রের দাবদাহের পর সাধারণত বৈশাখের শুরুতে কালবৈশাখীর মাধ্যমে স্বস্তি নেমে আসে। এর পর নিয়মিত ঝড়-বৃষ্টিতে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়। এপ্রিলে সাধারণত এক থেকে দুটি তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। এ ছাড়া এপ্রিল মাসে গড়ে সারা দেশে ১৬৬ মিলিমিটার ও ঢাকায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু এবার বৃষ্টির দেখা নেই। দেখা নেই কালবৈশাখীর। আর বৃষ্টির অভাবে দিন দিন বাড়ছে রোদের উত্তাপ। বাড়ছে তাপমাত্রা। দেশজুড়ে চলছে তাপপ্রবাহ। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। নষ্ট হচ্ছে মৌসুমি ফসল। এ পরিস্থিতিতে বৃষ্টির জন্য হাহাকার চলছে। বৃষ্টির জন্য দেশের অনেক এলাকায় বিশেষ নামাজ ও মোনাজাত হচ্ছে।
দীর্ঘ খরার কবলে পড়েছে রাজশাহীসহ পুরো উত্তরাঞ্চল। দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিহীন এ অঞ্চলে আম ও লিচুসহ বিভিন্ন ফসলেও প্রভাব পড়েছে। গাছের আমগুটি ঝরে পড়ছে। বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে লিচুর গুটি। দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ খরায় এখন আম ও লিচুর বাগান নিয়ে দিশেহারা এ অঞ্চলের লাখো কৃষক।
এরই মধ্যে লিচুর গাছে গাছে অজ্ঞাত রোগ দেখা দিয়েছে। এতে গাছের পাতা প্রথমে তামাটে বর্ণ ধারণ করছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। আর গাছে থাকা লিচুগুটি কালচে রঙ ধারণ করছে। ধীরে ধীরে রসে টইটুম্বুর হওয়ার বদলে চুপসে যাচ্ছে লিচু। তারপর ঝরে পড়ছে মাটিতে। বৃষ্টির অভাবে হতাশা ঘিরে ধরেছে রাজশাহীর লিচু চাষিদের। প্রতিষেধক হিসেবে নানা ওষুধ স্প্রে করেও সুফল পাচ্ছেন না তারা। চাষিরা জানান, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও লিচু গাছের এই রোগটি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছেন না। ফলে দিনে দিনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত খরার কারণে গাছ থেকে খসে পড়ছে আমের গুটিও।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। এই বাগান থেকে দুই হাজার ৭৫০ টন লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে লিচু চাষিরা বলছেন, মৌসুমের শুরুতেই তীব্র খরা আর অজানা রোগে লিচুর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।
এদিকে প্রচণ্ড খরায় গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ ও প্রাণিকুল। খরার কারণে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। এতে আমের ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা। আমবাগান মালিকরা জানান, তীব্র খরার কারণে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। জেলার বাঘা সদরের আম ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, এ বছর গাছে প্রচুর পরিমাণ মুকুল এসেছিল এবং ব্যাপক গুটি ছিল। এ কারণে লাভের আশায় উচ্চমূল্যে আমবাগান কিনেছিলাম। তবে চলমান খরার কারণে গাছ থেকে সমানে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। এ নিয়ে রীতিমতো তারা শঙ্কায় রয়েছেন।
অতিরিক্ত গরমের ফলে গরমজনিত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে হাসপাতালগুলোয়। এতে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি-কাশিসহ বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ সব বয়সের মানুষ। এ অবস্থায় গরমজনিত নানা রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের তরল খাবার এবং ঠাণ্ডা জায়গায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ডায়রিয়ার জীবাণুর বংশবিস্তারের অনুক‚ল পরিবেশ তৈরি করে এবং ডায়রিয়ায় বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। এ জন্য বেশি বেশি পানি পান করা এবং ঠাণ্ডা জায়গায় থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এল নিনোর কারণে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝ বরাবর তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে আফ্রিকা থেকে শুরু হয়ে পূর্ব এশিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত আবহাওয়াগত খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও পড়েছে। এল নিনো হচ্ছে বায়ুুমণ্ডলীয় এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সমুদ্রগুলোর মাঝে একটি পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তন। এর প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার লক্ষণ দেখা দেয় এবং আবহাওয়ার নিয়মিত ধরনগুলোতে পরিবর্তন দেখা দেয়। এল নিনো হচ্ছে পর্যায়বৃত্তের উষ্ণ পর্যায়, আর লা নিনা হচ্ছে শীতল পর্যায়। পর্যায়বৃত্ত এই পরিবর্তনের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, তবে প্রতি ৩ থেকে ৮ বছরের মাঝে দেখা যায়। এল নিনো বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এল নিনো ২০১৬ সালেও থাকবে বলে জানান আবহাওয়াবিদরা।