মো. মাহমুদুল হাসান :: ‘হবে নাকি, হচ্ছে নাকি!?’— এমন সংশয়ের মাঝেও হয়ে গেলো ১০ম জাতীয় সংসদ ‘নির্বাচন’। কিন্তু এটিকে কি আসলে নির্বাচন বলা যায়? অনেকেই বলবেন, বলা যায়। কারণ, এই পক্ষটি আওয়ামী লীগার। আবার অনেকে বলবেন, এটি কোনো নির্বাচনই নয়। আর এই পক্ষটি বিএনপি। তাদের ভাষায়, এটি প্রহসনের নির্বাচন।
আর আমরা যারা সাধারণ মানুষ, এদেশের সাধারণ নাগরিক— তারা কী বলবো? আসলে আমাদের বলার কিছু নেই। আমাদের কেবল চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে দুটি রাজনৈতিক দলের গোয়ার্তুমি। আমি দল বলবো না, মাত্র দুজন মানুষ বলবো। একজন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা, আর অপরজন বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। মূলত তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছার কাছেই বন্দি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। তাদের ইচ্ছায়ই সব হচ্ছে। অবশ্য বর্তমানে বিএনপির মেরুদণ্ড বাঁকা। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মুরদ তাদের নেই। আমি এখন সে প্রসঙ্গে যাবো না। দেশে বর্তমানে সবকিছু চলছে একজন মাত্র মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছার ওপরে। আর তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতাগোষ্ঠী আর শুভানুধ্যায়ীদের কথা ‘থোরাই কেয়ার’ করেছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনে কোন্ দল গেলো না গেলো তা নিয়ে তাঁর ভাববার ফুরসত নেই। তাঁর দরকার চেয়ার। কেউ ওই চেয়ারে বসতে বলুক আর না-ই বলুক চেয়ার তাঁর দখলে থাকা চাই।
আমরা মাঠে থেকে দেখেছি, ৫ জানুয়ারি আসলে ভোটের নামে কী হয়েছে। এটাকে কি নির্বাচন বলে? এটাকে কি ভোটাভুটি বলে? খেলা কি কখনও একপক্ষে হয়? শুধু তা-ই নয়, সচিবালয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও সরকারের অনেক বড় সমর্থকদের মুখেও হতাশা দেখেছি। তারা অকপটে স্বীকার করেছেন, নির্বাচনে বিএনপি গেলে ‘ভালো’ হতো। কিন্তু ওই যে ‘সংবিধানে’র দোহাই! নির্বাচিত সরকারপ্রধানের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে! হয়েছেও তা-ই।
তবে এর ফলে কী হয়েছে? মানুষজনের মনে আওয়ামী লীগের প্রতি আগের সেই শ্রদ্ধা আর নেই। যারা ঘোরতর আওয়ামী লীগ করতো তারাও যেন লজ্জায় মরে। কারণ এটাকে জোর করেই ক্ষমতায় থাকা বলে। খেলতে গিয়ে মাঠে যদি প্রতিপক্ষ দল না থাকলে তাহলে নিজের দলের কোনো সদস্য বা সমর্থককে প্রতিপক্ষে দাঁড় করালে দর্শকদের আস্থা কোনোভাবেই পাওয়া যায় না। দর্শকও খেলাটি উপভোগ করে না। কারণ দর্শক নামের জনগণ ছলচাতুরি পছন্দ করে না। এবারের নির্বাচনটিও হয়েছে তাই। আওয়ামী লীগ নোংরাভাবে ফাউল খেলেছে রাজনীতির মাঠে। নিজেরই সমর্থক এবং জোটবদ্ধ জাতীয় পার্টিকে দাঁড় করিয়েছে ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে।
‘অভিনব’ একটি নির্বাচনের পর অভিনব এক ‘সরকার’ও ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় পার্টি সরকারেও থাকবে, বিরোধী দলেও থাকবে। তার মানে দাঁড়ায়, তারা গাছেরটাও খাবে, নিচেরটাও কুড়াবে। আর ‘গাছের পাহাড়াদার’ আওয়ামী লীগ দাঁড়িয়ে থেকে বলবে, সব খেয়ো না কিন্তু! অন্যদিকে আমরা, গাছের মালিক জনগণ দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বলদের মতো কেবল ‘হাম্বা হাম্বা’ করবো।
আওয়ামী লীগের প্রতি, কিংবা কোনো দলের প্রতিই আমার ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা বা মিত্রতা নেই। কারো পক্ষে বা বিপক্ষেও আমি নই। আওয়ামী লীগ জনগণের ভালোবাসা নিয়ে ১০০ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর খোদ আওয়ামী লীগের লোকজনই চরম বিরক্ত, এ ধরনের নামকাওয়াস্তে নির্বাচন হওয়া নিয়ে, সরকার ‘গঠন’ হওয়া নিয়ে। এবার সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ১৫৩টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা হয়। বেশিরভাগ লোকই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন নি। অথচ ভোট তাদের অধিকার। তাহলে কে কেড়ে নিলো সেই অধিকার? এমন নির্বাচনের নামে কেন রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হলো।
আমাদের তো মনে আছে, সেই দিন বেশি পেছনে নয়, বছর কয়েক আগের কথা। দুই নেত্রীর গোয়ার্তুমির কারণেই সেনারা এসেছিল ক্ষমতায়। আমরা, মানে জনগণ সবসময়ই গণতন্ত্রের পক্ষে। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে নেতাদের মনগড়া, চাপিয়ে দেয়া কোনো সিদ্ধান্তও কেউ মেনে নেবে না। অতীতেও নেয় নি, ভবিষ্যতেও নেবে না। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, বর্তমানে নিচ্ছে কেন? জবাবে বলতে পারি, বর্তমানেও নিচ্ছে না। তারা আপনাদের (হাসিনা-খালেদা) ওপর চরম বিরক্ত। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে আপনাদের গালি দেয়। ঘুমোতে যাবার আগে গালি দেয়। মনে রাখবেন, তারা আপনার ও আপনাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হচ্ছে। প্রস্তুতি নিচ্ছে ভেতরে ভেতরে, রাজপথে নামা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের নির্বাচনে জনগণের পূর্ণ আস্থা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। দেশজুড়ে তখন বয়ে গেছে আনন্দের বন্যা। কিন্তু এবার আমরা কী দেখছি? কারো মধ্যেই যেন কোনো স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। সবাই যেন কেমন মনমরা। এমনকি নিজ দলের কর্মী-সমর্থকরাও। কারণ আওয়ামী লীগ মুখে যতই বলুক না কেন, দেশের জন্য আমরা এই করেছি, সেই করেছি। কিন্তু জনগণ জানে, কত নেতিবাচক ঘটনাও তারা ঘটিয়েছে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির জন্য চিহ্নিত ব্যক্তিদের শাস্তি দেন নি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির মতো এমন বড় ঘটনায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা শাস্তি পান নি, পদ্মাসেতু নিয়ে তুঘলকি কারবারও বন্ধ হয় নি, রানাপ্লাজায় সহস্রাধিক প্রাণহানির জন্য দায়ী কেউ এখনও শাস্তি পেলো না, একজন মন্ত্রী যাকে কালোবিড়াল বলে সবাই চেনে, তাকে ঘুষ-কেলেঙ্কারির কারণে অপসারণ করেও কেন দপ্তরবিহীন করে রাখা? আর অন্যদিকে আছে, খুন-গুম, জুলুম-নির্যাতনের হাজারো চিত্র। জিজ্ঞাসাবাদের নামে ঘর থেকে র্যাব-পুলিশ পরিচয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুম ও খুনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। দেশ যদি এভাবেই চলে তাহলে কী দরকার সরকারের? কী দরকার এমনতর অভিনব নির্বাচনের, কী দরকার এমনতর অভিনব সরকারের?
লেখক : বার্তাবাংলা’র প্রধান সম্পাদক