এম. এম. বাদশাহ্ :: বৃহস্পতিবার সকালে আরেক সহকর্মী সামির (এশিয়ান টিভিতে এখন) ফোন করে যখন বলল, ভাই নয়ন মারা গেছে, তখন কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম।…
এর পরে সারা দিন অফিসের এ্যাসাইনমেন্ট করেছি, ব্যস্ত ছিলাম কিন্তু কোন ভাবেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে নয়ন ভাই, যত টুকু শুনেছি প্রেশার হাই হওয়ায় দ্রুত চাঁদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কিন্তু অবস্থার অবনতি হলেই ঢাকা নেয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তার। কিন্তু ঢাকায় আসার পথে সে চলে নায় না ফেরার দেশে।
এখন শুধু মনে পড়ে তার ফেলে যাওয়া সব এলোমেলো স্মৃতিগুলো।
দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও চাকরী না হওয়াতে নিজ বাড়ি চাদপুরে চলে যান অভিমানী এই সহকর্মী। সেখানে মোবাইল ফ্লেক্সিলোড এর দোকান দেন তিনি। অনেকদিন ফোন করে বলেছেন ভাই কেউ তো চাকরী দিতে চায় না। তাই কিছূ একটা করতে তো হবে।
পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছুই নেই নয়ন ভাইকে।মাইটিভিতে কাজ করতে যখন তখন থেকেই জানতাম তাকে। সাইফুল ইসলাম নয়ন। একজন সম্প্রচার সাংবাদিক। একজন দক্ষ ক্যামেরাপারসন। যার হাতে আর উঠবে না ১৭০ কিংবা ১৭৭ বা ৩৯০ অথবা ৪০০ মডেলের ক্যামেরা। বলবে না বাদশাহ ভাই রেডি, লাইভে যান, কিংবা পিটিসি দেন।
সবশেষ ২০১৩ সালের ৫ ই মে এ্যাসাইনমেন্ট করেছি তার সাথে। হেফাজতের ঢাকা অবস্থান। সেদিন সকাল থেকেই বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় নয়ন ভাই আমার সাথে লাইভ টিমে ছিলেন। ব্রডকাস্টের কিংবা আইটির লোকজন তখনো না পৌছায় নয়ন ভাই নিজেই তাদের সে কাজ করে আমাদের সকালের নিউজ বুলেটিনের লাইভ করছিলেন। এরপর বৃষ্টি, পুলিশ হেফাজত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া… এমন করতে করতে দুপুর বারোটা। সাড়ে বারোটারি দিকে যখন গুলিস্তান পার হয়ে অফিসের দিকে ফিরছিলাম সুন্দরবন মার্কেটের পাশেই শুরু হয় হেফাজত পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামীলীগের ত্রিমুখি সংঘর্ষ। মূহুর্তে সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় গাড়িতে থাকা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট কিংবা হেলমেট কেউই পড়তে পারিনি। কিন্তু নয়ন ভাই, শুধু ক্যামেরা হাতে কই যেন হারিয়ে গেলেন। চারদিকে পুলিশের গুলি, বিক্ষোভকারীদের ককটেল, ঢিল ছোড়া। খুজতে লাগলাম নয়ন ভাইকে। একসময় বিআরটিসি কাউন্টারে পাশে পেলাম নয়নকে। দেখলাম ততক্ষনে তার পিঠে পুলিশের ছড়া গুলি লেগেছে অন্তত ১৫-২০ টা (একবারে গুলি করলে ছোট ছোট অনেক গুলো গুলি বের হয়)।দ্রুত নিয়ে যেতে চাইলাম হাসপাতালে , কিন্তু সে বলল তাড়াহুড়া করতে হবে না বাদশাহ্ ভাই। আপনি নিউজ নিয়ে অফিসে ঢুকেন আমি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে যাই। তার পর অফিস থেকে সহকর্মী জাফর ভাই, এডমিনের মুজাহিদ ভাই বাবু ভাই’রা (দিগন্ত টিভি) দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেই নয়ন ভাই, যে কিনা নিজের অসুস্থতার চেয়েও কাজকে প্রাধান্য দিতেন, কোন দিন এ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে বলেন নাই, ভাই আমার শিফট শেষ, সেই মানুষটা আজি নিজেই শেষ হয়ে গেলেন। গতকাল ৮ জানুয়ারী’২০১৪ রাতে তিনি চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে।খুব অভিমান নিয়ে… অভিমানি নয়ন ভাই ক্ষমা করো আমাদের …ক্ষমা করো… তোমার অভিমানের কি জবাব দিব বল?
নয়ন ভাই তুমি চলে গেলা। আমাদের ছেড়ে একাই চলে গেলা। কি অভিমান তোমার? ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা তোমার সাথে শেষ কথা হয়েছিল। সেদিন সকালে তুমি ফোন দিয়েছিলে। ব্যস্ততার কারণে ধরতে পারিনাই। নিজের দায়বদ্ধতা থেকে বিকেলে তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম। তুমি জানালে এই মাত্র দাউদকান্দি থানা থেকে তুমি ছাড়া পেলে। নিজেই বুঝে নিয়েছিলাম এশিয়ান টিভিতে ইন্টারভিউ দিতে তুমি সকালে রওনা দিয়েছিলে গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে। আর বিরোধী দলের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচী থাকায় তোমাকে আটক করা হয়েছিল দাউদকান্দি ব্রিজ থেকে। পুলিশ সদস্যদের তুমি বলেছিল বিরোধীদলের কর্মসূচীতে নয় চাকুরীর আন্টারভিউ দিতে তুমি ঢাকায় যাচ্ছ। ভদ্রতা দেখিয়ে পুলিশ তোমার কাছে ইন্টারভিউ কার্ড চেয়েছিল। তোমার কাছে তো কোন ইন্টারভিউ কার্ড ছিলনা। কারণ ওরাতো (পুলিশ) জানেনা অভিজ্ঞ মিডিয়া কর্মীদের চাকুরীতে ইন্টারভিউ কার্ড লাগেনা। অনকলেই ইন্টারভিউ দিতে হয়। আর তাতেই তোমাকে আটক করে দিন ভর থানায় রাখা হয়। তোমাকে সন্ধ্যায় ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু কেড়ে নিয়েছিল মানিব্যাগ। হায়রে পুলিশ। তুমি জানালে বাড়ি চলে যাচ্ছো। বলে ছিলাম তাহলে কাল (30 ডিসেম্বর) আবার আসেন। ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করবো। কিন্তু তুমি আর এলেনা। মাঝ খানে একদিন আর তোমার সাথে কথা হলোনা। তোমার তো চাকুরী ছিল। কেন তুমি বেকার হলে (দিগন্ত টিভি বন্ধ)। আর কেনই বা তোমাকে চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে আসতে দেয়া হলোনা। এ বিষয়টি সবার কাছে পরিস্কার। নয়ন ভাই সেদিন ইন্টারভিউ দিতে আসলে তোমার চাকুরী হতো নিশ্চিত বলতে পারলাম না তবে চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলোনা। কারণ আমি তোমার মলিন মুখ দেখেছিলাম। এ মলিন মুখ নিয়ে তুমি চলে গেলা? নয়ন ভাই তুমি ক্ষমা করো। তোমার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : এম. এম. বাদশাহ্, সিনিয়র রিপোর্টার, এসএটিভি