ধর্ষকদের হাতে রূপা নিহত হয়েছেন গত ১৫ আগস্ট রাতে। তাঁর চার ধর্ষক ধরাও পড়েছে। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। পুলিশের তদন্তকারী দেখেন শুধু অপরাধ। অপরাধের চরিত্র কী, কারা কেন তা করেছে, কী তার প্রমাণ; এসব খুঁজে বের করাই তাঁদের কাজ। আসুন প্রিয় মানুষেরা, মানুষ হয়ে, মানুষের মধ্যে পুরুষ হয়ে আরেকটা মানবিক তদন্ত আমরা করি। এটা আমাদের দায়িত্ব। পুরুষ হিসেবে এই দায়িত্বটা আমাদেরই ধর্ষক ভাইয়েরা আমাদের দিয়েছে। এই তদন্তের আওতা পুলিশি তদন্তের সীমার আরও বাইরে, অপরাধের দৃশ্যমান চেহারার আরও গভীরে। অর্থাৎ, আমাদের সামনে শুধু ধর্ষণের শিকার হওয়া রূপা নামের মেয়েটির লাশই নেই, আমাদের সামনে থাকতে হবে জীবিত রূপা। এই রূপা মধুপুরের বনের মধ্যে পড়ে থাকা এক ঘাড়ভাঙা, নির্যাতিত, দলিত-মথিত লাশ নয়, এই রূপা ২৯ বছর বয়সী এক জীবনসংগ্রামী নারী।
এই পুরুষপ্রধান পৃথিবীতে আমাদের এই সমাজে রূপাদের জন্ম হয় আনন্দেই। কিন্তু বড় হতে হতেই তার মধ্যে জন্ম নেয় এক ভয়: অনাকাঙ্ক্ষিত হাত, চোখ, মুখ, স্পর্শ, লিঙ্গ এবং শরীরের ভয়। বেশির ভাগ সময়ই সেই অনাকাঙ্ক্ষিত হাতটা, মুখটা, চোখটা, স্পর্শটা, দেহটা, লিঙ্গটা হয় কোনো পুরুষের। ভয়ের নাম পুরুষ, যে পুরুষ তার আপন, প্রিয়, নিরাপদ ও সহযোগী পুরুষের মতো নয়। এই পুরুষ ‘অন্য’ পুরুষ। এই অন্য পুরুষ ধর্ষক পুরুষ। এই পুরুষ কেমন হয় আগে থেকে তা জানা যায় না। হয়তো সে আর দশজনের মতোই, রাস্তায়, ঘরে, কর্মস্থলে, আত্মীয়সভায় কিংবা টিভিতে যাদের দেখা হয়—তাদের কোনোজন তেমন পুরুষ, তা মেয়েটি জানতে পারে না। কেবল ঝড়ের রাতে বিদ্যুৎ চমকে দেখা নেকড়ের মুখের মতো, ধর্ষণ-নির্যাতনের সময় তার সেই মুখটা দেখা যায়, যার ভয় পুষে রেখে অনেক মেয়েই বড় হতে থাকে। যত বড় হয়, ভয়টাও তত বড় হয় তার সঙ্গে। অনেক পুরুষই হয়তো নিজের সেই মুখটি নিজে দেখতে পায় না। কেন পায় না তা পরে বলছি। অনেক মেয়ের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়ের মতো, অনেক পুরুষের মনের ভেতর সেই ধর্ষক মানসিকতা লুকিয়ে থাকে। লুকিয়ে থাকে বাসনা হয়ে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে পড়া একটা মেয়ের স্ট্যাটাসের মতো রূপাও হয়তো মনে মনে ভাবতেন, ‘আমি সবসময় এইটা প্রে (দোয়া) করতাম—এই সব বাজে জিনিস যাতে আমি ফেস না করি (মুখোমুখি না হই)। বাট সি অ্যাগেইন, আমি ফেস করছি (কিন্তু দেখ, আমি মুখোমুখি হলাম)।’ বিষাক্ত বেদনার জ্বালা নিয়ে কথাটা বলার সুযোগ পাননি রূপা। চলন্ত বাসের মধ্যে ওই বাসেরই চালকসহ পাঁচ কর্মী ছিল, তারা তাকে ধর্ষণের সময় হত্যা করে। ধর্ষকদের সেই ধর্ষণেচ্ছু মুখ, হত্যাকারীদের সেই হত্যারত চোখের কথা রূপা আমাদের জানিয়ে যেতে পারেননি। সেই মুখ কেবল নিপীড়িতই দেখতে পায়, আর কারও সঙ্গে তাদের হয় নাকো দেখা। পুলিশ যখন ধর্ষক দলের পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, ততক্ষণে সেই ঘাতক-ধর্ষকের মুখচ্ছবি তারা লুকিয়ে ফেলেছে। পুলিশ বলেছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা নির্বিকার ছিল।
২.
মগজধারী প্রাণীদের মধ্যে মানুষের মগজেই অনুভূতি বেশি, বুদ্ধি বেশি। সেই মগজও একটা নিয়মে চলে। সেখানে আনন্দ ও বেদনা, কামনা ও হিংসার অনুভূতি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করে। কিন্তু মানুষের মধ্যেও এমন মানুষ আছে, যাদের মধ্যে আনন্দ ও বেদনা, ভালোবাসা ও ঘৃণার অনুভূতি একাকার হয়ে যায়। অপরকে কষ্ট দিয়ে তারা আনন্দ পায়, হিংসার মাধ্যমে তারা কামনা-বাসনা পূরণ করে সুখ পায়। ধর্ষণের সুখ তাই কেবলই মানুষের; কোনো পশু বা প্রাণীর নয়।
মানুষই একমাত্র প্রাণী হয়তো, যারা স্বজ্ঞানে অপরকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। পশু ধর্ষণ করে না, কারণ তার মধ্যে ভালো-মন্দ বোধ নেই। তার এই জ্ঞান নেই যে, কোন আচরণে আরেকজন কষ্ট পায়। মানুষের এর সবই আছে, তাই মানুষ মানুষ হয়েছে। আর সেই মানুষ প্রাণী হিসেবে হত্যা ও শিকার আজও ভুলতে পারেনি। বরং তার মগজে এমন বিকারের জন্ম সে দিতে পেরেছে, সমাজ-পরিবেশ-রাষ্ট্র থেকে এমন উৎসাহ সে পেয়েছে যে ধর্ষণে তার আনন্দ হয়, হত্যায় সেই আনন্দ আরও চরমে ওঠে। মানবতার এই বিকার, সভ্যতার এই বিকৃতি, সহমর্মিতার এই ধ্বংস মানুষেরই কীর্তি।
সেই কীর্তিমানেরা ক্ষণিকের বাসনায়, নির্জনতার সুযোগে রূপাদের মতো, তনুদের মতো, আফসানাদের মতো, বগুড়ার সেই মেয়েটির মতো কত মেয়ের চলমান জীবনে ইতি টেনে দেয়! রূপার জীবনের দিকে দেখুন। কৃষকের মেয়েটি টিউশনি করে দূরের শহরের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছেন। পোশাক কারখানার মাননিয়ন্ত্রকের চাকরি থেকে উঠে এসেছেন বহুজাতিক কোম্পানির বিপণনকর্মীর চাকরিতে। তাঁর জেদ থামেনি। আইন নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনাও চলছিল চাকরির পাশাপাশি। বগুড়ায় পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন তিনি শিক্ষকতার চাকরির। আর ফিরছিলেন কর্মস্থলের শহর শেরপুরে। পথে উঠতে হয় বাসে, পথে নামে রাত, বনের মধ্যে হামলে পড়ে শিকারি পুরুষ। রূপা নামের জীবনের রেখাটি তাদের পাশবিক হাতের চাপে ভেঙে পড়ে। ঘাড়ভাঙা রুপা যেন জীবনের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া এক যোদ্ধার ট্র্যাজিক পরিণতি। কিন্তু এটা কি সত্যিই পরিণতি হতে পারে? রূপা তো একটা সফলতার পরিণতির জন্যই যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন।
বাড়িতে মা চোখ মেলে দেখেন মেয়ের পথ চলার সংগ্রাম। জীবনের গোড়া শক্ত করে বাঁধবার, আপন কর্মের জোরে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। রূপার জীবননদী বহু পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পার হয়ে সুখের সাগরে মিশতে চেয়েছিল। সেটা কী? মায়ের মুখে হাসি, ভাইয়ের শান্তি আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক মর্যাদাপূর্ণ জীবন। এই সামান্য সুখ, শান্তি, মর্যাদার জন্য মানুষ কত-না সংগ্রাম করে। রূপার সেই সংগ্রাম একটা অসমাপ্ত মহাকাব্যের বেদনার মতো, একটা দৌড়ের ঘোড়ার ঘাড় ভেঙে পড়ার মতো।
৩.
প্রিয় পাঠক, আবার ধর্ষকদের দিকে তাকান। তাদের পেছনে পরিবহনশ্রমিকদের শক্তিশালী সংগঠন আর আমাদের দুর্বল আইন-প্রশাসনের দিকে তাকান। তাকান বিচারপ্রার্থী মায়ের দিকে। তাকান নিজের দিকে। সব ঠিক আছে কি? প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন করুন, প্রশ্ন করুন। প্রশ্ন করুন, জীবনের দৌড়ে রূপা কেন বাড়ি ফিরতে পারলেন না! শুধু পাঁচজন ধর্ষকের দলের কাজ তো এ না। কেন গণপরিবহন নিরাপদ না, কেন ধর্ষণমানসিকতা এত জোরদার, কেন অধিকাংশ ঘটনারই বিচার হয় না, কেন এ সমাজে রূপার মতো মেয়েদের মায়েদের ভাঙাচোরা নির্যাতিত একটা লাশ পেতে হয়, যে নাকি ছিল তাঁদের আত্মার থেকেও আপন ও প্রিয়!