
ছোট ইরফান মাকে বলত,”কিন্তু মা ওরা তো হিন্দু, ওদের মূর্তিতো কথা বলতে পারেনা,তাহলে কেন ওরা অইতাকে আল্লাহ্ বলে মানে?”।
ইরফানের আম্মু বলতো,” ওরা ওতে বিশ্বাস করে।আর কারও বিশ্বাসে আঘাত করতে হয়না।তুমি ওদেরকে বুঝাতে পারো , ইসলামের পথে আহবান করতে পারো কিন্তু ওদের কোন ক্ষতি করতে পারোনা। আর নবীজি বলে গেছেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে না ” ।
ইরফান এভাবেই বড় হতে থাকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাসায় ভাড়া থাকাকালীন সময়ে ইরফান দেখে অনেক হিন্দু প্রতিবেশীই ইরাফনের আম্মুর খুব কাছের লোক হয়ে গেছে, এক খ্রিস্টান মহিলার হাঁস রান্নার কথাত সে প্রায়ই বলত।অথচ, ইরফানের আম্মু কোনদিনও এক ওয়াক্ত নামাজ ও ক্বাযা করেননি, কোনদিনও হিজাব ছাড়া বাড়ির বাইরে যাননি ।
ইরফানের মামা হেলাল মিয়াজির ঘনিস্ত বন্ধু ছিল আশিস কুমার।প্রায়ই ইরফানদের বাসায় এসে খাবার খেত।ইরফানের মা তাকে নিজের ছোট ভাইর মতো দেখত। আশিস হিন্দু ছিল বিধায় ইরফানের নানি প্রায়ই কেমন কেমন জানি করতো বলতো,” একই প্লেটে হিন্দু-মুসলমান খাবে!!!!”
এর জন্য ইরফানের আম্মু তার আশিস কাকুর জন্য আলাদা প্লেট রেখে দিয়েছিল।অথচ, কোনদিন আশিস কাকু টা জানতেও পারেনি। দুর্গা পুজর সময় ইরফান আশিস কাকুর সাথে মেলায় জেত,কাকুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে পিস্তল কিনত,খেলনার পিস্তল, প্রায়ই। এমন কি ঈদের সময়ও কাকু ওকে সালামি দিতো।
মাধ্যমিকে পড়ার সময় সাহা বাবু ও তপন স্যারের কাছে সে গনিত,বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিখতে যেত। তার কাছে কখনই মনে হয়নি ওনাদের সাথে ইরফানের ধর্মের পার্থক্য আছে। বরং সরস্বতী পুজর সময় মাসির হাতের রান্না করা খিচুড়ি,বেগুন ভাজা, চাটনি,নিরামিষ, নারিকেলের নাড়ু ও মিষ্টি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতো।এমনকি মাধ্যমিক শেষ হয়ে গেলেও স্যারের বাসায় ঠিকই যেত পুজর সময়। উচ্চ মাধ্যমিকে এসে সুব্রত স্যার ও তপন স্যারের কাছে যেত ইংরেজি শিক্ষার জন্য।ইরফান তাদের কাছে শুধু ইংরেজই শিখতোনা এ দুজন মানুষের ব্যাক্তিত্ত তাকে সব সময় মুগ্ধ করতো।
প্রদীপ ও সজীব চৌধুরী নামে ইরফানের দুটি হিন্দু বন্ধুও আছে।এরা প্রায়ই বিপদের দিনে সাহায্য করে, যদিও অর্ণব নামের এক হিন্দু ছেলেকে সে দেখতে পারেনা।
ইরফান এখন বড় হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার শেষ পর্যায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরার সময় সে কোনদিনও পার্থক্য করতে পারেনি হিন্দু ও মুসলমানদের, যদিও ইরফানের ছিল ইসলামের প্রতি অগাত আনুগত্য।সে প্রায়ই ইসলাম নিয়ে চিন্তা করে। বিশ্বে মুসলমানদের মার খাওয়া দেখে সে কষ্ট পায়।ইরানের ইসলামী বিপ্লব তাকে অনুপ্রানিত করে। বিশ্ব মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের জন্য তার মনে সব সময় একটা কিছু করার জন্য ছটপট করে। তার নিজের দেশের মুসলমানদের মধ্যে এতো বিভাজন দেখে সে খুব চিন্তিত থাকে।কি করা যায়?? কি করা যায় ?? আবার জিহাদের নামে কিছু মূর্খ মুসলমানদের সন্ত্রাসী হামলা কিংবা গ্রামে-গঞ্জে অশিক্ষিত কিছু মুসলমানদের উল্টাপাল্টা ফতোয়া জারি করা ইরফানকে রাগান্বিত করে।কারন সে জানে জিহাদের মানে কি? কখন কোন সময় মুসলমানদের কি রকম জিহাদ করা উচিত।পবিত্র কোরআনে ৪১ বার জিহাদ সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং ের ব্যাখা দেওয়া আছে। সে জানে কাদের ফতোয়া দেয়ার অধিকার আছে, কোন সময় কি রকম ফতোয়া দেওয়া উচিত। ফতোয়ার নামে বাংলাদেশে যে অবলা নারিদের উপর যে অন্যায় অত্যাচার করা হয়, মাঝে মাঝে ইরফানের ইচ্ছা হয় ওদেরকে মুরতাদ ঘোষণা করতে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় সে দেখে অনেক ছেলে মেয়েরাই নাস্তিকতাকে এক রকম ফ্যাশন হিসেবেই নিয়েছে। সে বুঝেই পায়না, একজন শিক্ষিত ব্যাক্তি কিভাবে বিশ্বাস করে যে সৃষ্টি কর্তা নেই!!!! আর সে আরেকটা প্রস্নের উত্তর পায়না, কেন নাস্তিকরা শুধু মাত্র ইসলামের বিরুদ্ধেই লেখে!!! নাস্তিকতা মানেতো সে কোন ধর্মেই বিশ্বাস করবেনা, তাহলে ঐ সব নাস্তিকদের তো উচিত সব ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা, কেন শুধু মাত্র ইসলাম??
কাল পহেলা বৈশাখ, বাঙ্গালী নববর্ষের প্রথম দিন, ইরফান তার বন্ধুদের সাহে মেলায় যাবে, বাঙ্গালীর প্রানের উৎসবে যোগ দিতে। ইরফান একজন বাঙ্গালী হিসাবে গর্ব করে কারন তার আছে ভাষা আন্দোলনের গর্বের ইতিহাস ও প্রভাত ফেরির অভ্যাস , তার আছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস, স্বাধীনতা দিবসের লাল সূর্য আর বিজয় দিবসের উল্লাস।তার আছে পহেলা বইশাখ,হালখাতা, গ্রীষ্মের আম-জাম-কাঁঠালের রস, পাখিদের কলকাকলি, ইলিশ ভাজা, বর্ষার রিমঝিম, শরতের কাশফুল, হেমন্তের পাকা ধানের গন্ধ,শীতের খেজুরের রসের পিঠা আর ভালবাসার বসন্ত। সে মনে প্রানে একজন বাঙ্গালী, একজন বাঙ্গালী মুসলমান।
ইরফানের মতো অনেক ছেলে-মেয়েই আছে বাংলাদেশে যারা একাধারে মুসলমান ও বাঙ্গালী। তারা জানে বাঙ্গালী হাজার বছর ধরে অসাম্প্রদায়িক। তারা জানে দেশে যতবারই সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হয়েছে টা নিতান্তই নষ্ট রাজনীতির ফল, আর ের দায়ভার ওইসব নষ্ট রাজনীতিবিদদের। কারন, একজন সত্যিকারের মুসলামান কখনই ঐ সব নিরীহ অমুসলিমদের উপর হামলা করেনা।
তাহলে আজ কেন নতুন করে বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করতে চাচ্ছে?? বাঙ্গালীতো কোনদিন সাম্প্রদায়িক ছিলই না।
তাহলে, নতুন করে এই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা ঐ মানুষগুলোর কাছে অসাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা কী???
লেথক : ছাত্র; সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।