সুমন সিকদার :: জীবন কখনো থেমে থাকে না এটাই স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক হয় তখন যখন এই জীবনকে থামিয়ে দেওয়া। কারো চলার পথে সৃষ্টি করা হয় বাধাঁ। আজ থেকে দুই বছর আগে ঝালকাঠির লিমনের স্বাভাবিক জীবনে নেমে এসেছিল অস্বাভাবিক জীবনের খড়গ। কোন কারন ছাড়াই র্যাবের গুলিতে লিমনকে হতে হয়েছে পঙ্গু।
২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠি রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে মোরশেদ জোমাদ্দার নামে এক সন্ত্রাসীকে ধরতে যায় পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাব ৮ এর একটি দল। এসময় এক হতদরিদ্্র পরিবারের কলেজ ছাত্র লিমন মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরছিল। ঠিক তখনি ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের স্বীকার হতে হয় লিমনকে। র্যাবের সাথে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে উত্তেজিত এক র্যাব সদস্য গুলি করে লিমনের বাম পায়ে। এসময় এই খবরটি বিভিন্ন টেলিভিশন, রেডিও, স্থানীয় ও জাতীয় পত্র পত্রিকায় বেশ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। ধিরে ধিরে পা হারা পঙ্গু লিমন পরিনত হয় এক নাবিকবিহীন নৌকায়। তার চারপাশে বেঁচে থাকার মত কোন অবলম্বন খুজে পাচ্ছিলনা সে।
এর পর শুরু অসহায় লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমানের চেষ্টা। পঙ্গু লিমনকে নিয়ে ঘটনা আরো জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী বাহিনী র্যাব সদস্যরা লিমনের পায়ে গুলি করা যে তাদের ভুল ছিল তা স্বীকার করতে রাজি নয়। তাই এবার র্যাব মাঠে নামল লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমানের কাজে তারই ধারাবাহিকতায় লিমনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়। এটা বুঝতে আমাদের আর অসুবিধা হবার কথা নয় যে, লিমনকে সন্ত্রাসী প্রমাণের জন্যই এই মামলা দেয়া হয়েছিল। ভুল স্বীকার তো দূরের কথা একটি মিথ্যা ঢাকবার জন্য যেমন আরও একাধিক মিথ্যা বলতে হয়, লিমনের ক্ষেত্রেও র্যাবের ভূমিকা ছিল সেরকমই। তবে লিমনের পাশে দাঁড়ায় দেশের গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ।
ঘটনার ১৩ দিন পর ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় চরম নিষ্ঠুরতা শিরোনামে লিমনের ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। মূলত এরপরেই অন্যান্য সংবাদমাধ্যমও এই খবরটিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ ও প্রচার করে। পাশা পাশি অনলাইন মিডিয়া গুলোও থেমে থাকেনি প্রচারে।
লিমনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে আসা হলে তাকে ঢাকার পক্সগু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে লিমনকে দেখতে গিয়ে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানের অঝোরে কান্নার দৃশ্য দেশের বিভিন্ন টেলিভিশনে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। এবং এই দৃশ্য সকলেরই লিমনের জন্য আলাদা একটা সহানুভূতি তৈরি হয়। এমন মর্মস্পর্শী ঘটনা স্পর্শ করে যায় সবার হৃদয়। দেশের প্রতিটি মানুষের মাঝে জন্ম নেয় লিমনের জন্য ভালোবাসা।
আইনশৃঙ্খলা বাহীনির দৌরাত্বে লিমনের এলাকার মানুষ রাগে ক্ষোভে ক্ষিপ্ত হয়ে যখন সাংবাদিকদের কাছে পরিষ্কার করেই বলেছিলেন যে, লিমন অপরাধী নয় এবং সে কোন অপরাধী চক্রের সাথে জড়িত নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দিন মজুরের সাথে কথা বলে জানাগেছে, লিমনকে যখন অসুস্থ অবস্থায় বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার এলাকাবাসী তার জন্য চাঁদা তুলে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার, আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরন করতে হয়েছিল তাকে। এমন সব খবরও যখন সংবাদমাধ্যমে এসেছে তখনও সর্বস্ব হারানো নিঃস্ব এই পরিবারটিকে সন্ত্রাসী প্রমাণের জন্য র্যাব উঠেপড়ে লাগে।
সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাও এই পরিবার টিকে প্রমান করতে চাচ্ছিলেন সন্ত্রাসী পরিবার। কিন্তু না তাদেও পাশে ছিল গণমাধ্যম ও দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ। কিন্তু আইনের মার প্যাচে মার খেতে হয়েছে বার বার। লিমনের মাকে কাঁদতে হয়েছে আদালতের চত্বরে। লিমনকে ফেলতে হয়েছে চোখের জল। তবুও সঠিক বিচার পায়নি তারা।
অবশেষে গত ৯ জুলাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, লিমনের বিরুদ্ধে র্যাবের দায়ের করা মামলা দুটি প্রত্যাহার করে নেয়া হবে এবং কোনো শর্ত ছাড়াই। সরকারের এ সিদান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দেশের সচেতন মহল। লিমনকে সরকারের এই সিদ্ধান্তের খবরটি জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তাছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দিন খান আলমগীরও সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা লিমনের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । তার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দেড়িতে হলে লিমনের ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয়েছে।
এ বিষয়ে লিমন বলেছেন, সরকার দীর্ঘদিন পরে হলেও তার প্রতি ন্যায় বিচার করেছেন তবে যখন করেছেন তখন আর কিছু নেই। সরকারের বিচার ন্যায় সঙ্গত হলেও আমি ফিরে পাবোনা আর কোন দিন আমার অতীত ফিরে পাবো না আমার পা। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়েই কাটাতে হবে আমায়। তবে এতোদিন পর হলেও আমার মনে হয় আমি বিজয়ী হয়েছি আর আমার এ বিজয় আমার একার নয় বরং সারা দেশের গরিব অবহেলিত নির্যাতিত মানুষের বিজয়।
দুই বছর পরে হলেও লিমনের মাথার উপর দিয়ে নেমে গেছে খড়গ। তবে ভাগ্যোর নির্মম পরিহাসে তাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে পঙ্গুত্ব। তবে র্যাবে মত এমন একটা বাহীনি দ্বারা কখনো মানুষের ক্ষতি হতে পারে এটা বিশ্বাস করা যায়না। কারন র্যাবের প্রতি দেশের সাধারন মানুষের রয়েছে অঘাত বিশ্বাস। ইতোমধ্যে তারা দেশের অপরাধী দমন, জঙ্গি দমনে এই বাহিনীর ভুমিকা উল্লেখ যোগ্য। মানুষ কেউ ফেরেস্তা নয়। র্যাব ও তার উর্দ্ধে নয় তাই কিছু ভাল কাজ করলে দুই একটি ভূল হবেই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হয় তখনি যখন সেই ভুল স্বীকার না করে আবার পুনরায় ভুল করে। লিমনের ব্যাপারে র্যাবের ভুমিকা এর বেশি কিছু নয়। তবে অবশেষে সরকারের সিদান্তকে সঠিক সিদ্বান্ত মনে করছেন সবাই।
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
মন্তব্য যুক্ত করুন