মনোয়ার হোসেন :: সামনেই জাতীয় বাজেট (২০১৩-১৪)। প্রতিবছরই বাজেটকে উপলক্ষ্য করে তামাক কোম্পানিগুলি তামাকপণ্যে যাতে করারোপ না হয় সে লক্ষ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তমূলক তথ্য উপস্থাপন করে বিভিন্ন সভা-সেমিনার এবং মানববন্ধনের মাধ্যমে। কয়েক দিন আগেও দুই শতাধিক সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ডিও লেটার পাঠিয়েছে যাতে তামাকপণ্যের ওপর করারোপ না করে। প্রতিবছরই তামাক কোম্পানিগুলি এরকম কাজ সম্পন্ন করে। এধরনের কাজে সংসদ সদস্য ছাড়াও কোম্পানি ব্যবহার করে গবেষক, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষাবিদদেরকে। তারা কম দামি সিগারেটে করারোপ বৃদ্ধি করতে বলেন, বিড়ির ওপর করারোপ করতে নিষেধ করে, বিড়ির ওপর করারোপ করলে লাখ লাখ বিড়ি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে বলে তারা প্রচার চালায়, বিশেষ করে লাখ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করবে বলে বিভ্রান্তি ছড়ায়। এছাড়াও বিড়ি থেকে সিগারেটে ক্ষতি বেশি এবং ধূমপান হ্রাসকরণে কমদামি সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করার সুপারিশ করে। এরকম নানাবিধ অসংগতিপূর্ণ ও মিথ্যা তথ্য তারা উপস্থাপন করার মাধ্যমে নীতি-নির্ধারকদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। প্রতিবছরই তারা এই ধরনের মিথ্যাচার করার মাধ্যমে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে তামাকপণ্যে কর না বাড়ানোর অপতৎপরতা চালিয়ে এসেছে। তামাক কোম্পানির উপরোক্ত মিথগুলো আস্তে আস্তে রাজনীতিবিদগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিকেরা বিড়ির ওপর করারোপ করলে ২৪ লাখ বিড়ি শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, এর মধ্যে ১৮ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করবে বলে যে মিথের কথা প্রচার করে সে বিষয়ে বর্তমানে অনেকেই ওয়াকিবহাল। দুজন গণমাধ্যমকর্মীর গবেষণা থেকে জানা গেছে যে বিড়ি শ্রমিক (প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ) তিন লাখের উপরে নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আশার কথা হচ্ছে, এ বিষয়ে বর্তমানে অনেক সংসদ সদস্যের ভুল ভেঙেছে। যে কারণে এ বছর জাতীয় বাজেটে বিড়ি সিগারেটসহ সব ধরনের তামাকপণ্যের উপর যাতে করারোপ বৃদ্ধি করা হয় সে বিষয়ে ৪০ জন মাননীয় সংসদ সদস্য প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা ৭০ শতাংশ করারোপের প্রস্তাবসম্বলিত ডিও লেটারের মাধ্যমে রাজস্ব বোর্ডকে উপরোক্ত প্রস্তাব দিয়েছেন। যেসব সংসদ সদস্যগণ রাজস্ব বোর্ডকে ডিও লেটার দিয়েছেন তার মধ্যে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খানও রয়েছেন। ডিও লেটার শুধু মহাজোটের সংসদ সদস্যগণই দেননি, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরাও এই তালিকায় সামিল রয়েছেন।
মাননীয় সাংসদগণ সিগারেটের উপর নির্ধারিত যে চারটি মূল্যস্তর বা স্ল্যাব আছে তা উঠিয়ে দিয়ে একটি অভিন্ন কর কাঠামো তৈরি করার পরামর্শ প্রদান করেছেন। এছাড়া দেশের রাজস্ব নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যাতে সবোর্চ্চ প্রাধান্য পায় সে বিষয়েও বিবেচনায় অর্ন্তভূক্তকরণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। সাংসদগণ রাজস্ব বোর্ডকে দেওয়া ডিও লেটারের মাধ্যমে তারা তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেছেন, তাদের মত, প্রতিবছরই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু তামাকজাত দ্রব্যের দাম একই জায়গায় ঠাঁই দাড়িয়ে আছে। তামাক কোম্পানিগুলি তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দাম বৃদ্ধি পেলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে – এরকম প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সাংসদগণ ডিও লেটারের মাধ্যমে তাদের অভিমতে প্রকাশ করেন যে তামাক শিল্প থেকে লাভবান হয় কোম্পানিগুলো এবং ক্ষতিগ্রস্ত হন চাষী, তামাক শিল্পে জড়িত শ্রমিক এবং ব্যবহারকারীরা। তারা বিশ্ব ব্যাংকের একটি গবেষণার ঊদ্ধৃতি দিয়ে মত প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রিত হলে প্রায় ১৯ শতাংশের কাছাকাছি চাকরি বৃদ্ধি পাবে এবং রাজস্বও বাড়বে।
উপরোক্ত বাস্তবতা ও পরিস্থিতির আলোকে মাননীয় সাংসদগণ বিড়ি, সিগারেট, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য – জর্দা, গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের উপর সম্পূরক শুল্কের হার ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করার পরামর্শ প্রদান করেছেন। সেই সাথে সিগারেটের চারস্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তর বাড়িয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলিকে বাড়তি সুবিধা প্রদান না করে বরং চারস্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তর তুলে দিয়ে সব ধরনের সিগারেট, বিড়িসহ অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যের উপর একই হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন।
যেসব মাননীয় সাংসদ তামাকপণ্যের উ্পর ৭০ শতাংশ করারোপের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা হলেন সাবের হোমেন চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন, আসাদুজ্জামান খান কামাল, অধ্যক্ষ খাদিজা খাতুন শেফালী, পারভীন আক্তার, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, মোশতাক আহমত রুহী, মো. আব্দুল ওদুদ, অধ্যক্ষ মো: মতিউর রহমান, নাজমা আকতার, বেগম নাসরিন জাহান, এডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, মেরাজ উদ্দীন মোল্লা, ফজলে হোসেন বাদশ, মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান, শেফালী মমতাজ, মুহিবুর রহমান মানিক অন্যতম। আগামী ৩রা জুন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে উপরোক্ত সাংসদগণ তামাকপণ্যের উপর কর বৃদ্ধির জোরালো দাবি জানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মনোয়ার হোসেন : বার্তাবাংলার বিশেষ প্রতিনিধি ও লেখক
