রাজধানীর ধানমণ্ডির নামকরা একটি স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র সাদমান (ছদ্মনাম)। পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় বাবা-মায়ের কাছে বায়না একটু বেশিই। চাওয়ার আগেই পেয়ে যায় অনেককিছু। লেটেস্ট মডেলের ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোন তার জন্য যেন একেবারে পান্তাভাত! বাবা-মা দুজনই তাদের কাজে ব্যস্ত থাকায় যন্ত্রপাতিই তার সঙ্গী! বাস্তবে না থাকলেও ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই সাদমানের। স্কুলের সময়টুকু বাদ দিলে ফেসবুকেই সারাটা সময় কাটে তার। কিন্তু একসময় এটিও বিরক্তিকর মনে হয় তার কাছে। ইন্টারনেটে ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় ঘটে বিভিন্ন পর্নো সাইটের। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেসব সাইটে সময় কাটায় সাদমান। তার কাছে এটি নেশার মতোই।
ঘরে ঘরে ইন্টারনেটসংযোগসহ কম্পিউটার আর মোবাইল ফোনের ছড়াছড়িতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ ধরনের চিত্র এখন হরহামেশা। ইন্টারনেটের অনেক ভালো দিক থাকলেও অন্ধকার কিছু দিকও বিপথে ঠেলে দিচ্ছে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরীদের। ইন্টারনেটে সন্তানটি কী করছেÑপরিবারের বাবা-মা কিংবা সিনিয়রদের সে বিষয়ে বিশেষ ‘খোঁজ-খবর’ না থাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। ইন্টারনেটে বিভিন্ন পর্নো-সাইটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। মাল্টিমিডিয়া ফোনের কল্যাণে তা বেড়েছে বহুগুণ। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ইন্টারনেটে জ্ঞানের সন্ধান করার নামে পর্নোগ্রাফির প্রতি ঝুঁকে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ যে বয়সে কিশোর-কিশোরীরা তা করছে সেটি জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এ সময় এ ধরনের ঝোঁক বা ক্ষেত্রবিশেষে আসক্তির ফলে পুরো জীবনই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বখে যেতে পারে সন্তানটি। তাই এ বিষয়ে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তথ্য কমিশনার ড. সাদেকা হালিম বলেন, পর্নোগ্রাফির বিস্তার ঠেকাতে পরিবারকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তান মুঠোফোন কী কাজে ব্যবহার করছে, কী ধরনের ওয়েবসাইটে বসছে তা মা-বাবাকেই নজরদারি করতে হবে। তিনি বলেন, পর্নোগ্রাফির অবাধ বিস্তারই যৌন ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এই অপসংস্কৃতির হাত থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেতন হতে হবে। প্রতিদিন কতজন কিশোর-কিশোরী কতগুলো পর্নোসাইট ভিজিট করে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। এ বিষয়ে গুগলের সিঙ্গাপুর অফিসে একটি মেইল করেও জানার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া ইন্টারনেট নিয়ে কাজ করে, বাংলাদেশী এমন কয়েকটি সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য কিছু শব্দ ‘গুগল অ্যাডওয়ার্ডসে’র মাধ্যমে খুঁজে বের করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যেগুলোর সার্চের পরিমাণ নেহাত কম নয়!
‘পর্ন’ শব্দটি গুগলের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মাসে গড়ে ৮ লাখ ২৩ হাজার বার সার্চ করা হয়। এই শব্দটির বৈশ্বিক সার্চসংখ্যা মাসে ৬১ কোটি ৮০ লাখ। ‘সেক্স’ শব্দটি গুগলের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে খোঁজা হয় মাসে ২২ লাখ ৪০ হাজার আর বিশ্বে ৫০ কোটি ৬ লাখ বার। আর ‘এক্সএক্সএক্স মুভিজ’ বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ৫০০, বিশ্বে ১ কোটি ৬৬ লাখ, ‘পর্ন মুভিজ’ শব্দটি বাংলাদেশ থেকে ৯০ হাজার ৫০০, বিশ্বে ৩ কোটি ৭২ লাখ বার খোঁজা হয়। এছাড়া ‘সেক্স ভিডিও’ শিরোনামে বাংলাদেশ থেকে মাসে গড়ে সাড়ে ৪ লাখ এবং পৃথিবীতে গড়ে ৪ কোটি ৫৫ লাখ সার্চ হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সার্চের একটি বিশাল অংশ হয় তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীদের মাধ্যমে। কারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। শুধু গুগল অ্যাডওয়ার্ডসই নয়, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক আর সমাজকর্মীরাও জানিয়েছেন শিশু-কিশোরদের ইন্টারনেট-পর্নে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি। মগবাজারের একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই এখন কম-বেশি মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহার করে। তারা যে ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন পর্নো ক্লিপ্স ডাউনলোড করে দেখে, তা তাদের মোবাইল ফোন চেক করে প্রমাণ পেয়েছি।
সরকারি একটি স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আশিকের মা গৃহবধূ শাহনাজ পারভীন বলেন, ছেলে বায়না ধরেছে কম্পিউটার কিনে দিতে। ইন্টারনেটের সংযোগও রয়েছে। অনেকসময়ই দেখি বন্ধুবান্ধব নিয়ে কম্পিউটারে সময় কাটায়। পরে স্কুল থেকে অভিযোগ পেয়ে এখন ছেলের ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছি। এ প্রসঙ্গে আইটি বিশেষজ্ঞ রাজীব সরকার বলেন, কিশোর-তরুণদের মধ্যে যে ইন্টারনেট-পর্নের ঝোঁক রয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ের আইটি ডিভাইসটি অভিভাবকরা যদি ‘সেফ ব্রাউজিং’য়ের ব্যবস্থা করে রাখেন তাহলে অনেকাংশে পর্নোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক কমানো সম্ভব।
অন্যদিকে পর্নোগ্রাফি রোধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং ৫ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রেখে ২০১১ সালে যে আইন হয়েছে তার সঠিক বাস্তবায়ন হলেও শিশু-কিশোররা এর হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে করছেন সমাজকর্মীরা। এ প্রসঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আরসিডি’র কর্মকর্তা আবুল হাসান বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন দিয়েই পর্নোগ্রাফি রোধ করা সম্ভব। পর্নোসাইটগুলো বাংলাদেশে বন্ধ করে দিলেও শিশু-কিশোররা এর কুফল থেকে মুক্তি পেতে পারে।