মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা শিতি জনগোষ্টীর একাংশ মানুষ না হয়ে যেন দিন দিন কেমন অদ্ভুত প্রাণীতে পরিণত হচ্ছি। আজকের এই সভ্য লোকালয়ে আমাদের যে ভাবে চলাফেরা করা উচিত, আমরা যেন তেমন ভাবে চলতে পারছি না কিংবা বলা যায় ইচ্ছে করেই চলতে চাই না। কেমন একটা খাপছাড়া ভাব আমাদেরকে চরম থেকে চরমতর হিং¯্রতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আজ চলমান অবস্থায় শিতি জনগোষ্টীর একাংশের বিবেকহীন কর্মকান্ড দেখে কেউ কেউ বলেন, আজকের দিনে এমন হওয়াটাই স¦াভাবিক। শিতি জনগোষ্টির একটা অংশের জেনারেশনের শিখড় খোঁজতে গেলে দেখা যাবে, হয়তো তার পূর্ববর্তী জেনারেশনে শিার আলো প্রবেশ করেনি কিংবা ছিল না। কথায় বলেনা যে যতই শিতি হোকনা কেন, তিন জেনারেশন যদি শিতি না হয়, তা হলে সে যতই শিতি হোক না কেন তার চলাফেরার মধ্যে অস্বাভাবিকতা থেকেই যাবে। তার কর্মকান্ডের মধ্যে এমন সব বিষয় আশয় ফুটে উঠবে, যা দেখলে যে কেউ অবাক হবেন এবং অবাক হয়ে বলবেন এত লেখাপড়া করে অর্থাৎ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কিংবা ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলী কিংবা কোন শিা প্রতিষ্ঠানের শিক হয়ে যদি কেউ ন্যূনতম ভদ্রতা সমাজের মানুষকে দেখাতে না পারেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির লেখাপড়া করার কি দরকার ছিল? সিনেমা হলের সামনে কিংবা স্কুল কলেজের সামনে পান সিগারেটের কিংবা চানাচুর বাদামের দোকান নিয়ে বসলেই তো হতো। স্কুল কলেজের সামনে কিংবা সিনেমা হলের গেটে দাঁড়িয়ে পান সিগারেট কিংবা চানাচুর বাদাম বিক্রি করার জন্যতো পড়াশোনার প্রয়োজন হয় না। পাঠশালা পাশ করলেই চলে। দিনও চলে যেত হেসে খেলে। তখন কেউ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটির কাছ থেকে যে ন্যায়পরতা আশা করা হয়েছিল, সেই ন্যায়পরতা কেউ আশা করতো না। অথচ একজন লোক যখন সমাজ এবং রাষ্ট্রের উচ্চ স্তরে বাসকরে অর্থাৎ বিচারক, ম্যাজিষ্ট্রেট, ডাক্তার, প্রকৌশলী, এবং আইনজীবী হয়ে অশিতি মানুষের মতো আচরণ করেন, তখন যে কোন মানুষ ইচ্ছে করলেই প্রশ্ন তোলতে পারে, আমরা কোন সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাস করছি?
যে সমাজ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন ম্যাজিষ্ট্রেট, বিচারক কিংবা একজন প্রকৌশলী কিংবা আইনজীবী কিংবা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক নিজেই জানেন না তার ওজন কতটা ভারী। তার দায়বদ্ধতা কতটুকু। তখন কি মানুষকে সংশ্লিষ্টরা দোষারোপ করতে পারবেন কিংবা যারা প্রশ্ন তুলবে তাদেরকে দোষারোপ করার নৈতিক অধিকার কি সংশ্লিষ্টরা রাখেন। কেননা একজন লোক যখন জানবে তার সাথে বেয়াদবের মত আচরণ করা লোকটা ছিল অনেক পড়াশোনা জানা একজন আমলা কিংবা একজন ডাক্তার কিংবা সমাজের প্রতিষ্ঠিত একজন শিতি ভদ্রলোক, তখন সে মনের দুঃখে জানতেই চাইবে একজন শিতি লোক যদি ইতরের মতো আচরণ করে তা হলে তো জনমানবের ভবিষ্যত গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবেই। সামাজিক পতন যারা ঠেকাবেন, তারা যদি নিজের আচরণের মধ্যে শুদ্ধতার বিকাশ না ঘটিয়ে সবকিছুকে পতনের শেষ সীমায় নিয়ে যান, তা হলে তাদের আর থাকে কি? অহংকার করার মতো কিছু কি অবশিষ্ট আর তাদের মধ্যে থাকে। যারা লোকালয়ের মানুষের উন্নতি চান, তারা বলবেন মানুষের সাথে অভদ্র আচরণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অহংকার করার মতো কিছুই থাকে না।.
এক শ্রেণীর মানুষের অন্ধ অহংকার সব কিছুকে পতনের দিকে নিবেই। কেউ আর সেখানে মন খোলে কথা বলতে পারবেনা। মনের গভীর গভীরে গলার কাঁটার যন্ত্রনার মতো যন্ত্রনা থাকবেই। অসহায় মানুষকে তা সহ্য করতে হবে।তাকে মনে করতে হবে সকল যন্ত্রনা তার পাওনা। কেননা অসহায় মানুষের না আছে অর্থের বল, না আছে বিত্তের বল। দুটির কোনটাই যদি না থাকে একটা মানুষ চলবে কেমন করে। সবাই বলবেন অর্থ বিত্ত ছাড়া এখন কেউ চলতেই পারে না।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদ পড়ে জানলাম একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এর বাসা থেকে নির্যাতিত এক কাজের মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযোগ করা হচ্ছে জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এর বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া বীথি নামে কাজের মেয়েটির ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে। বলা হচ্ছে গৃহকর্তা ও তার স্ত্রী বীথির ওপর বর্বরের মতো এতটাই নির্যাতন চালিয়েছেন যে, যা অনেকের পে ভাষায় প্রকাশ করাই সম্ভব নয়। শিশুটির শরীরে নাকি ঢালা হয়েছে গরম ভাতের মাড় এবং দেওয়া হয়েছে খুন্তির ছেঁকা। এই অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে বিচারের দাবীতে মানুষ মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে কান্না জড়িত কন্ঠে অনেকেই বলেছেন, অত্যাচারিত এই শিশুকে দেখলে মনে হবে দূর্ভী পীড়িত আফ্রিকার কোন অঞ্চলের কংকালসার মানব শিশু। শিশুটিকে উদ্ধার করে বাইশ ধারায় জবানবন্দী নেওয়া হয়েছে। বীথির পিতার অভিযোগ চৌদ্দ মাস ধরে তাকে তার মেয়ের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।
মেয়ের কংকালসার চেহারা দেখে তিনি বলেন, আমার মেয়ে এমন ছিল না। আমার মেয়ের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। উদ্ধার হওয়া বীথিও বলেছে জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের শ্বাশুরীর বাড়ীতে এগার মাস থাকার সময় তার ওপর বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাকে হাত মুখ বেঁধে নির্দয় ভাবে নির্যাতন করতো জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের শ্বাশুরী। দেওয়া হতো গরম খুন্তি ও রুটি তৈরির গরম তাওয়া দিয়ে ছেঁকা। আরও অনেক অভিযোগ আছে। যেমন বীথি বলেছে আর শরীরে লবণ জল ঢেলে দেওয়া হতো। তাকে টয়লেটে আটকে রাখা হয়েছিল দুইদিন। সেখানে সে টেপের জল পান করে দুই দিনের ুধা নিবারণ করেছিল। এমনও অভিযোগ আছে তার জামা কাপড় খোলে ফেলা হতো। তার শরীরের এমন সব জায়গায় হাত দেওয়া হতো যা মুখে বলা যায় না। অভিযোগ করা হচ্ছে নির্যাতনের সময় বীথির মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হতো, যাতে সে চিৎকার করতে না পারে। এছাড়া শিশু বীথিকে ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না। সকালে দুটি রুটি, রাতে পঁচা পান্থা ভাত খেতে দেওয়া হতো। কতটা নির্দয় হলে বীথির মতো একটি শিশুর ওপর এমন আচরণ করা হতে পারে, মানুষ তা সহজেই বুঝে নিতে পারে। ডাক্তারের ভাষ্য হচ্ছে বীথির শরীরে একাধিক তের চিহ্ন রয়েছে। এর মধ্যে পিঠের মধ্যে যে ত চিহ্ন রয়েছে, সেটা গরম কিছু দিয়ে ছেঁকা দেওয়ার জন্য দগদগে তে রূপনিয়েছে। ডাক্তার এমন কথাও বলেছেন শিশুটির মানসিক চিকিৎসারও প্রয়োজন রয়েছে। এদিকে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসায় শিশু নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবীতে এবং নির্যাতনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবীতে সাতীরা প্রেস কাবের সামনে মানব বন্ধন ও সমাবেশ করেছে সাতীরার সচেতন নাগরিক সমাজ। মানব বন্ধন শেষে প্রতিবাদ মুখর মানুষ থানার বড় কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারের দাবী জানান। ছোট শিশু বীথির ওপর বর্বর নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট ও তার স্ত্রী এবং শ্বাশুড়ির ওপরে। ভাবতেই যেন কেমন লাগে!
এখন কথা হচ্ছে, একজন জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এর দায়িত্ব যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করে সমাজের শান্তি বিনষ্ঠকারীদের শাস্তি দেয়া, সেখানে ওনার নিজের বাসায় বীথির মতো অসহায় একটা মেয়েকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। এসব দেখে বলা যায়, কে কার বিচার করবে। কেননা বিচারক যদি অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তা হলে তো জীবন নাটকের স্বাভাবিক দৃশ্যাবলী অন্যরকম হতে বাধ্য। আমাদের দেশের গরীব ঘরের মেয়েরা একমুঠো ভাতের জন্য যে বয়সে তার পড়াশোনা করার কথা, সেই বয়সে মানুষের বাসা বাড়ীতে কাজ করতে যায়। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজে এক শ্রেণীর নতুন ভদ্রলোকরা এই সব অসহায় মানুষের সন্তানের ওপর এমন ভাবে অকথ্য নির্যাতন চালায়, যা কখনও ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মূল কথা হচ্ছে, এখনো আমাদের চৈতন্যের মধ্যে এই সত্যটা প্রকাশ পয়নি যে, প্রত্যেকটা মানুষেরই তার মৌলিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকার এই মৌলিক অধিকার মানুষের জন্মগত। সেই অধিকার মানুষকে দিয়েছে সুশীল সমাজের রীতিনীতি এবং একটা কল্যানমূখী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কিংবা এই স্তরের মানুষজন তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ন্যায় বিচারের পরিধী বিস্তৃত করতে না পারলে, সমাজের আর দশ জন মানুষ তা করবে কি করে। আবার এমন কথাও বলা যায় যে, একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট যদি নিজের পরিবারে বা তার আশেপাশের মানুষের মধ্যে ন্যায়বোধ কিংবা নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা ছড়াতে না পারেন, তা হলে তো কখনো সম্ভব হবে না ওনার পে কোর্ট কাচারীতে ন্যায় বিচার সম্পন্ন করা। অসহায় শিশু বীথির ওপর অত্যাচারের যে কাহিনী আমরা শুনলাম, তা শুনে আমরা এতটুকুই বলতে পারি, আমরা এখনো সভ্য সমাজে বসবাস করার মত মানুষ হিসাবে নিজেদেরকে তৈরি করতে পারিনি। আমরা এখনো সভ্যতার আলোকরাশি থেকে অনেক অনেক দূরে রয়ে গেছি। আজ আমরা যতই চিৎকার করে বলিনা কেন, আমরা সকল নীতি নৈতিককতা মেনে চলি, বাস্তব েেত্র আমরা এখনো চরম বর্বরতাকে আশ্রয় করে বেঁচে আছি। পত্র/পত্রিকা পড়ে মনে হলো অসহায় শিশু বীথির ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তার বিচারের দাবীতে মানুষ জেগে উঠেছে। আবার এমন কথাও শোনা গেছে, যার ওপর অভিযোগ করা হয়েছে, সেই সংশ্লিষ্ট জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটেকে বিচারিক মতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় অর্থাৎ কাজের মেয়ে শিশু বীথির ওপর অত্যাচারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিচারককে হয়তোবা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মানুষ যদি জেগে থাকে তাহলেই সম্ভব হবে এই অন্যায়ের বিচার করা।
এছাড়া অন্যরা যারা অসহায় শিশুটিকে অত্যাচার করেছে তাদেরও শাস্তি হতে পারে। কিন্তু এখানে বড় হয়ে যা দেখা দিচ্ছে, তা হলো আমরা আজ কোন সভ্যতার ছায়া ঘেরা বিবর্ণ প্রান্তরে বসবাস করছি। আমাদের পায়ের তলার মাটি কি আমাদেরকে নিরাপত্তা দিতে পারছে? নাকি সেখানে কেউ কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে? আমরা শিতি জনগোষ্টির একটা অংশ কি একেবারে বিবেকহীন হয়ে পড়েছি। মানবিক মূল্যবোধ থেকে আমরা যেন যোজন যোজন দূরত্বে বসবাস করছি। যার জন্য একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট একটা শিশুর ওপর নির্যাতন করতে দ্বিধাবোধ করেন না। আবার তিনি যদি অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট যদি বলেন আমি কিছু করিনি, তাহলে বলতে হবে তিনি কোন অন্ধকারে বসবাস করেন। যেখানে বীথির মতো অবুঝ শিশুকে নির্যাতিত হতে দেখেন না কিংবা বলা যায় একটা শিশুকে নির্যাতিত হতে দেখেও নিশ্চুপ থাকেন। এমন প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এবং আমাদের সমাজের নতুন ভদ্রলোকেরাই দিতে পারবেন। মনে প্রশ্ন জাগে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কিংবা এই প্রকৃতির মানুষরা হৃদয়ের আলোক রেখা থেকে কত দূরে বাসকরেন।
লেখক :শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
কবি, গল্পকার, আইনজীবী,
কালীবাড়ী রোড, হবিগঞ্জ।