ঘটনাস্থল আমার অনেক আনন্দ-বেদনার প্রিয় শহর বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। মাত্র পনেরো বছর আগের কথা। সময়টা ২০০১-২০০২ সাল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। ততোদিনে পরিচিতজনরা দেখা হলেই বলতো কী সাংবাদিক, কেমন আছো, দেশ-বিদেশের সংবাদ কী? অথচ ঝর্ণা-পাহাড় ঘেরা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি চট্টগ্রাম শহরটাকেও ততোদিনে ঠিকমতো চিনে উঠতে পারি নি।
সুদূর খুলনায় আমার বাড়ি। বাড়ির লোকদের সাথে কিছুটা অভিমান করেই একদিন পালিয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রায় দু’বছর আত্নীয়-স্বজনদের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলাম। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটবিহীন সেই সময়ে অামার তেমন কেউ ছিলোনা, যার একটুখানি সহযোগিতা পাবো। কিন্তু কাছে-দূরের লোকদের এই সাংবাদিক সম্বোধনটা কেনো জানি খুব পীড়া দিচ্ছিলো। সাংবাদিক হলে সাংবাদিকতা পড়ার মানেটা কী! মনে হলো, যাই না শহরে, চেষ্টা করে দেখি, কী হয়!
মাত্র পনেরো বছর আগেও গণমাধ্যমের চাকরির বাজারের চিত্রটি ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের ছোট্ট এবং সংকীর্ণ।আমি শাটল ট্রেন ধরে বিকালবেলা শহরে যেতাম। একটা একটা করে স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকার অফিসগুলোতে ঢুঁ মারতাম। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া শুধুমাত্র একুশে টেলিভিশন সংবাদ পরিবেশন করতো। মুন্নী সাহারা তখনও স্টার (!) হয়ে ওঠেন নি। সেটারও তখন শৈশবকাল। এটিএন বাংলা, চ্যানেল আই ইত্যাদিতে নাসির গোল্ড-এর বিজ্ঞাপন আর যতসব ঠাকুরদার জমানার পুরাতন বাংলা সিনেমা দেখানো হতো।
প্যাকেজ নাটকের জোয়ার তখনও শুরু হয় নি। যা-ই হোক, এক পাতার হাতে লেখা বায়োডাটা নিয়ে আজ এ অফিস তো কালকে সেই অফিসে যেতাম। ফলাফল শূন্য। প্রায় প্রতিটি হাউজ থেকেই সম্মানের সহিত কখনোবা অসম্মানের সহিত ‘না’ শব্দটি শুনেই ফিরতাম। একটি দৈনিকের ব্যুরো চিফ যখন শুনলেন আমি সাংবাদিকতার ছাত্র, কালবিলম্ব না করে তর্জনী উচিয়ে খোলা দরজাখানা দেখিয়ে বললেন, এই পথ ধরে সোজা বাড়ি চলে যাও বাছা। আমরা সাংবাদিকতায় পড়া কোন লোককে আমাদের পত্রিকায় চাকরি দিবো না। মজার বিষয় হচ্ছে, ওই অফিস এখন আমার ছোট ভাই-বোনদের দখলে! সেই ’মহাজন’ যে কোথায় হারিয়ে গেলেন! ইতিহাস এভাবেই লেখা হয়। যা-ই হোক, আমিও নাছোড়বান্দা। একদিন খবর পেলাম, ‘ডেইলি লাইফ’ নামে চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক ইংরেজি দৈনিকে অশোক চৌধুরী নামে একজন ভদ্রলোক আছেন। অামি যেন তার সাথে দেখা করি। যিনি তাঁর সম্পর্কে তথ্য দিলেন, তিনি আমাকে একটু স্মার্ট হয়েই তার কাছে যাবার জন্য পরামর্শ দিলেন। বাড়ি থেকে পালানো এই তরুণটির তখন হাতেগোনা কয়েকটি প্যান্ট-শার্ট।বন্ধুর দেওয়া মাত্র একজোড়া স্যান্ডেল। সু কেনার পয়সা জোগাড় করে পারিনি তখনও।
বন্ধু মিয়া মোহাম্মদ আরিফ, বড়ভাই বর্তমানে ফিনল্যান্ডপ্রবাসী অফিউল হাসনাত রুহিন তখন ডেইলি লাইফে যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও স্টাফ রিপোর্টার। একদিন বিকেলে গিয়ে হাজির হলাম চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের বিপরীতে সেই অফিসটির সামনে। ততোদিনে চট্টগ্রামের সবগুলো পত্রিকা অফিস ঘুরে ঘুরে পত্রিকা অফিসগুলোর অবকাঠামো সম্পর্কে আমার একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ডেইলি লাইফ অফিস দেখে তো অামার মাথা ঘুরে যাবার মতো অবস্থা। সম্ভবত তিনতলা ঝকঝকে সাদা ডিস্টেম্পার করা বেশ পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন অফিসটির ভেতরে-বাইরে একই রকম। বৈশাখের গরমে বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘেমেই গিয়েছিলাম। ভেতরে ঢুকে মনে হলো পৌষ মাস। সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশন্ড! প্রত্যেকের জন্য আরাম কেদারা। পৃথক টেবিল। টেবিলের ওপরটা স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে ঢাকা। প্রতিটা টেবিলে ওইদিনের একটি পত্রিকা পেপারওয়েট দিয়ে চেপে রাখা। তখন সবার জন্য কম্পিউটার ছিলো না। হাতে লিখতে হতো। তাই পিস পিস করে নিউজপ্রিন্ট কাগজ। সেগুলো গাঁথার জন্য ছোট্ট ট্রেতে অনেকগুলো আলপিন।
দুরু দুরু বুকে অারিফ মিয়াকে নিয়ে একটি রুমের দরজায় দাঁড়ালাম। তিন-চারজন বন্ধু-শুভানুধ্যায়ী নিয়ে একজন ত্রিশোর্ধ দীর্ঘদেহী সুদর্শন একজন যুবক বসে বসে -টেলিভিশনে কী যেন একটা প্রোগ্রাম দেখছেন। তিনি ডেইলি লাইফ-এর তখনকার চীফ রিপোর্টার। পরিচ্ছন্ন, স্পষ্ট উচ্চারণ, সদালাপী এই ভদ্রলোক আর কেউ নন, বৈশাখী টেলিভিশনের বর্তমান হেড অব নিউজ এবং বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন – বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (বিএফইউজে)-এর সভাপতি প্রার্থী অশোক চৌধুরী।
কোনরকম ভাব-ভঙ্গি না নিয়ে চাছা-ছোলা ৪/৫টি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, উত্তর পেয়ে হয়তো সন্তুস্ট হলেন। বায়োডাটা নিলেন। দেখলেনও না। বললেন, আগামীকাল থেকে কাজ শুরু করুন। বেতন-ভাতা নিয়ে সম্পাদকের সাথে কখা বলে নিবেন। তবে ওইদিন গরম গরম তেল-পরোটা, মাংসভূনা আর চা না খেয়ে অাসতে দেন নি। পেশাদার সাংবাদিকতার সেই শুরু। মেঘে মেঘে ১৫টি বছর পেরিছে গেছে। ততোদিনে কর্ণফুলী দিয়ে লক্ষকোটি গ্যালন জল গড়িয়েছে বঙ্গোপসাগরে। আমিও সেদিনের নবীশ সাংবাদিকটি নেই। বয়স এখন মধ্য ত্রিশে। আর আশোক চৌধুরী চট্টগ্রামের মানুষদের হৃদয়-মন জয় করে এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা। বিএফইউজের নির্বাচনে যারা তাকে ভূঁইভোড় বলেন, তাদের জন্য আমার সাংবাদিকতার প্রথম মেন্টরকে নিয়ে আমার মতো করে এই স্মৃতিচারণ।
চট্টগ্রামের একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম নেওয়া অশোক চৌধুরী ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম তথা দেশের অন্যতম ’ছাত্রবহুল’ প্রতিষ্ঠান ওমর গণি এমইএস কলেজের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। নেতৃত্ব দেওয়ার স্বভাবজাত গুণগুলো তার মাঝে তখন থেকেই আমরা দেখে আসছি। তার মাঝে এক ধরণের বিশালতা দেখেছি, যেটা আরও অনেকের মাঝে খুঁজেছি, কিন্তু পাই নি।
এরপরে যতদিন ডেইলি লাইফে কাজ করেছি, শুধু তার স্নেহ আর ভালোবাসাই পেয়েছি। প্রতিদিন সন্ধ্যাতেই সাংবাদিক আর স্থানীয় সমাজের নানান জনের সঙ্গে তার আড্ডা-আলাপন। নানান ব্যঞ্জনার খাবার ছিলো নিয়মিতো। যার পুরো খরচটাই তিনি বহন করতেন।
সেদিনটির কথা খুব মনে পড়ে, যেদিন অশোক চট্টগ্রামের কর্ণফূলী সেতু নিয়ে এটিএন বাংলায় একটি প্যাকেজ নিউজে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। সম্ভবত ছোট একটুখানি পিটিসিও ছিলো। তার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, একটু নার্ভাসনেস! কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সবকিছু পাল্টে গেছে, কয়েকবছর পরে ঢাকায় এসে যখন এটিএন বাংলায় কোর্ট প্রতিবেদক হিসেবে তার তৈরি করা রিপোর্টগুলো দেখতাম, বেশ ভালো লাগতো, আর সেই প্রথম দিনটির কথা বেশ মনে পড়তো।
আমার খুব মনে পড়ে না, অশোক চৌধুরীকে কোন একটি পোশাক পরিধান করে সপ্তাহে কিংবা মাসে দুইবার অফিসে আসতে। একসময় তো মিমি সুপার মার্কেটের পাশে ‘মাত্রা’ নামে একটি পোশাকের শো-রুমও দিয়েছিলেন।নিমন্ত্রণ পেয়ে কিং অব চিটাগাং-এ তার বিয়েতেও আমরা গিয়েছিলাম। যদিও তখন অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম।
মৃদুভাষী অথচ দৃঢ়প্রত্যয়ী অশোক চৌধুরীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা মেশানো অকৃত্রিম একধরণের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। যা এখনও অমলিন। চট্টগ্রামের সেই সময়কার অধিকাংশ সাংবাদিকদেরও ছিলো তার প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ আর ভালোবাসা মেশানো মধুর সম্পর্ক।
ডেইলি লাইফ ছেড়ে ‘দি বাংলাদেশ অবজার্ভারে’ যোগ দেওয়ার পরও মাঝে মাঝে প্রথম কর্মস্থল আর অশোকদাকে দেখার জন্য যেতাম।
কালক্রমে যখন ঢাকায় এসে বাংলাদেশ অবজার্ভারে যোগ দিলাম, দেশের সবচেয়ে বড়(!) সাংবাদিক নেতার সঙ্গে কাজের সুযোগ হলো, অন্য নেতৃবৃন্দদের অনেকের সঙ্গেও কম-বেশি কাজের এবং জানার অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রয়াত আলতাফ মাহমুদের স্নেহের পরশও পেয়েছি অল্প-বিস্তর।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অশোক চৌধুরী তার রুচি, সৃজনশীলতা আর পরিচ্ছন্নতা দিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক ইউনিয়নের ধারাটাকে ইতিবাঁচক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম। এর গুণগত মানের পরিবর্তন আনতে পুরোপুরি সক্ষমতা রাখেন। তবে সুযোগটা দিতে হবে। দেশের সাংবাদিকদের এক সূঁতোয় বাধা আর নানান মত-পথ ও চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে সাংবাদিক কমিউনিটিকে বের করে মেরুদণ্ড সম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন, এমন প্রত্যাশা অশোক চৌধুরীর মতো একজনের কাছেই আমরা করতে পারি। তবে তার জন্য সকলের সমর্থণ প্রয়োজন। পুরাতনের অর্গল ভেঙে নতুনের জয়কেতন তো এভাবেই ওড়ে!
জাহিদ আল আমীন : সাংবাদিক ও গবেষক