বার্তাবাংলা রিপোর্ট :: বিচারপতিদের অপসারন সংক্রান্ত আলোচিত ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল, ২০১৪’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। সংবিধানের অংশ হতে কেবল রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর বাকি। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ৪০ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে ফিরে গেল জাতীয় সংসদের হাতে। শুধু বিচারপতি নয় এর পাশাপাশি দেশের সকল সাংবিধানিক পদ কিংবা অনুরূপ সকল পদের অপসারন ক্ষমতা চলে গেল সংসদের হাতে। অর্থ্যাৎ সরকারি কর্ম কমিশন(পিএসসি), নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক(সিএজি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মত অনুরূপ কমিশনারদের অপসারণের ক্ষমতাও পেল জাতীয় সংসদ। সংশয়টা এখান থেকেই শুরু। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ পদ হলেও নির্বাহী সকল ক্ষমতা থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। রীতি অনুযায়ী দেশের প্রধানমন্ত্রীই সাধারণত সংসদ নেতা হন। বাংলাদেশের সংসদকে যদি একটি পরিবার ধরা হয়, অলিখিতভাবে সেই পরিবারের কর্তাব্যাক্তিটি হলেন প্রধানমন্ত্রী। আর কর্তার ইচ্ছায় কর্ম্। সে হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেল, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য হুমকিসরূপ বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদতো রয়েছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়ে কোনভাবেই দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না তিনি। তাই সরকার চাইলেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারবে বলে মনে করছেন অনেকে। তাই পিএসসি, নির্বাচন কমিশন, দুদকের মতো যে কোন কমিশনের কমিশনারগন পূর্বের তুলনায় স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে আরো চাপের মধ্যে থাকবেন, বিশেষ করে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান যারা মন্ত্রী-এমপিসহ সকল ভিআইপির দুর্নীতি নিয়ে কাজ করেন তারা থাকবেন বেশি চাপে। অপসারনের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়ায় এই সব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মানসিক আরো চাপে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে,সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের কমিশনার, দুদকের চেয়ারম্যানসহ সকল কমিশনার, পিএসসির চেয়ারম্যান ও সদস্য, সিএজি অপসারণের পদ্ধতি ও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের অপসারন পদ্ধতি একই। তাই সব ক্ষমতা যদি সংসদের কাছে যায় তবে সংবিধান ভারসাম্য হারাতে পারে, যা আমাদের সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। সংবিধানের নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক অপসারণের বিষয়ে সংবিধানের ১১৮, ১৩৯ ও ১২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-‘সুপ্রীম কোর্টের কোন বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন, সেরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত (ইসি, পিএসসি, সিএজি) তারা অপসারিত হবেন না।’ অনুরূপভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ১০ নং ধারার (৩) উপধারা এবং মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯ এর ৫৩ নং ধারার ৮ (১) উপধারায় বলা হয়েছে,‘সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারক যেরূপ কারণ ও পদ্ধতিতে অপসারিত হইতে পারেন,সেইরূপ কারণ ও পদ্ধতি ব্যতীত চেয়ারম্যান বা কোন সদস্যকে অপসারণ করা যাইবে না’ এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে গেল। একই সঙ্গে অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান কিংবা একই ধরনের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেই কমিশনারদের অপসারণের ক্ষমতাও সংসদের হতে গেল। অন্যদিকে দুদক আইনের বিষয়ে দুদকের প্যানেল আইনজীবি এ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান রাইজিংবিডিকে জানান, দুদকের চেয়ার্ম্যান ও অপর দুই কমিশারগণের অপসারন ক্ষমতা বিচারপতিদের মতো অনুরূপভাবে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে জাতীয় সংসদের হাতে চলে গেল। দুদকের কর্মকান্ডে এর কোন প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান রাইজিংবিডিকে জানান, বিষয়টি জাতীয় সংসদে বিল পাসের মধ্য দিয়ে সুরাহা হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। সংবিধানের ৬৪ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা হয়েছে- ‘সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্য কোন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল-পদে নিয়োগদান করিবেন।’ তবে তার ক্ষেত্রে অপসারণ একই পদ্ধতিতে হবে কি না তা স্পষ্ট করা হয়নি সংবিধানে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল, ২০১৪ পাস হয়েছে। বিভক্তি ভোটে প্রস্তাবের পক্ষে ৩২৭ ভোট পড়লেও বিপক্ষে কেউ ভোট দেননি। যদিও বিলের সংশোধনী প্রস্তাবের সময় ৩২৮ জন সদস্য ভোট দেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং স্বতন্ত্র জোটের সদস্যসহ সবাই এই সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেন। এমনকি যেসব সদস্য সংশোধনী এনেছিলেন, তারাও নিজের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন। বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি জানিয়ে স্বাক্ষর করলে তা সংবিধানের অংশ হবে। সংসদকে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন,বিলের তিন দফা অনুযায়ী এ-সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়নের আগে সংবিধানের সংশোধিত ৯৬ অনুচ্ছেদটি কার্যকর হবে না। বিলের সংশোধনী প্রস্তাবে সদস্যদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে যা ছিল, সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পুনঃস্থাপিত হচ্ছে। শুধু প্রমাণিত গুরুতর অসদাচরণের ক্ষেত্রেই একজন বিচারককে অপসারণের কথা এখানে বলা হয়েছে,যা পাস হতে হবে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। এ সময় তিনি সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের আলোকে বিচারকদের জন্য নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নেরও অঙ্গীকার করেন।
মন্তব্য যুক্ত করুন