বিশ্বজুড়ে প্রবাসীদের জীবনমান, আয় এবং ক্যারিয়ার উন্নয়নের সুযোগ বিবেচনায় বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি একটি জরিপ চালিয়েছে। এতে ১৯০টি দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ২৭ হাজার প্রবাসীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
জরিপ অনুযায়ী, প্রবাসীদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেশ হিসেবে শীর্ষে রয়েছে সুইজারল্যান্ড।
চলুন দেখে নিই শীর্ষ ১০ দেশের প্রবাসী আয়ের চিত্র এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :
সুইজারল্যান্ড
উন্নত জীবনযাত্রা, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপদ পরিবেশের কারণে সুইজারল্যান্ড অনেক প্রবাসীর প্রথম পছন্দ। দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং এখানে উচ্চ বেতনের চাকরির সুযোগ ব্যাপক। এছাড়া কর্মক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ সময় ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। এখানকার জীবনযাত্রার মান বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত। তাই যেসব প্রবাসী নিরাপত্তা, আয় ও ব্যক্তিগত উন্নয়ন চান, তাদের জন্য এটি এক আদর্শ গন্তব্য।
- বার্ষিক গড় আয় : ১,৮৮,২৭৫ মার্কিন ডলার
- বাংলাদেশি টাকায় : প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ
- মাসিক আয় : ১২ লাখ+
জার্মানি
ইউরোপের অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং উৎপাদন খাতে প্রবাসীদের জন্য অসাধারণ সুযোগ তৈরি করে। এখানকার চাকরির বাজারে স্থিতিশীলতা রয়েছে এবং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আছে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তৃত সুযোগ। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নাগরিক অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা ও বাসস্থানের সহজলভ্যতাও প্রবাসীদের আকৃষ্ট করে। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তিও মেলে।
- বার্ষিক গড় আয় : ৯৭,৬৯৩ ডলার
সুইডেন
সুইডেন সামাজিক ন্যায়বিচার, টেকসই উন্নয়ন এবং কর্ম-জীবনের ভারসাম্যের জন্য বিখ্যাত। প্রবাসীরা এখানে সুশৃঙ্খল এবং শ্রদ্ধাশীল কর্মপরিবেশে কাজ করার সুযোগ পান। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা বিনামূল্যে পাওয়া যায় এবং এটি পরিবারসহ বসবাসের জন্যও আদর্শ একটি দেশ। প্রযুক্তি ও স্টার্টআপ খাতে এখানে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে তরুণ পেশাজীবীদের জন্য এটি এক চমৎকার গন্তব্য।
- বার্ষিক গড় আয় : ৮৪,৮০২ ডলার
- বাংলাদেশি টাকায় : প্রায় ৬৭ লাখ
সংযুক্ত আরব আমিরাত
দুবাই ও আবুধাবির মতো শহরগুলোর কারণে আমিরাত এখন বিশ্বজুড়ে প্রবাসীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। করমুক্ত আয়, আধুনিক অবকাঠামো ও আন্তর্জাতিক কর্মপরিবেশ প্রবাসীদের জন্য এ দেশকে আকর্ষণীয় করেছে। ব্যবসা ও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগও ব্যাপক। তবে উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আবাসন খরচ কিছুটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবুও যারা দ্রুত আয় করতে চান এবং ক্যারিয়ারে গতি আনতে চান, তাদের জন্য উপযুক্ত একটি জায়গা।
- বার্ষিক গড় আয় : ১,১২,৮২০ ডলার
- বাংলাদেশি টাকায় : প্রায় ৮৯ লাখ
নরওয়ে
নরওয়ে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানবিক নীতিমালা এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য পরিচিত। এখানে কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রাখা হয় খুব গুরুত্বসহকারে। প্রবাসীরা জানান, সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত এবং কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ তুলনামূলকভাবে কম। যারা পরিবারসহ বিদেশে স্থায়ী হতে চান, তাদের জন্য নরওয়ে অন্যতম সেরা পছন্দ হতে পারে।
- বার্ষিক গড় আয় : ৯৭,৪৮৬ ডলার
সিঙ্গাপুর
এশিয়ার প্রযুক্তি ও ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র সিঙ্গাপুর, যেখানে নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা এবং সুযোগ একত্রে পাওয়া যায়। এখানে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোতে কাজের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে ফিনটেক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। কর্মক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব এবং দক্ষতার গুরুত্ব দেওয়া হয়, ফলে প্রবাসীদের দ্রুত ক্যারিয়ার উন্নতি সম্ভব হয়। তবে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই ব্যয়ের দিকটাও বিবেচনায় রাখতে হয়।
- বার্ষিক গড় আয় : ১,৩৮,৬৪১ ডলার
অস্ট্রিয়া
অস্ট্রিয়া ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং উন্নত জীবনমানের সমন্বয় ঘটিয়েছে। ভিয়েনা শহরটি বারবার ‘বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহর’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্যসেবা, গণপরিবহন এবং কর্মক্ষেত্র প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। ইদানীং দেশটি প্রযুক্তি ও সৃজনশীল খাতে প্রবাসীদের আগ্রহ কাড়ছে। প্রথমবারের মতো শীর্ষ ১০-এ উঠে আসা এই দেশ এখন নতুন প্রবাসীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য হয়ে উঠছে।
- বার্ষিক গড় আয় : ৮৫,২৮৮ ডলার
হংকং
বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র হংকং— ব্যবসা, ব্যাংকিং ও প্রযুক্তির জন্য বিখ্যাত। কর কাঠামো তুলনামূলকভাবে সহজ এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সুবিধাজনক। প্রবাসীদের জন্য এখানে উচ্চ বেতনের সুযোগ রয়েছে, তবে বাসস্থান ও জীবনের খরচ অনেক বেশি। কর্মঘণ্টা বেশি হওয়ায় ব্যক্তিগত জীবনে চাপ অনুভব হতে পারে। যারা দ্রুত আয় করতে চান, তাদের জন্য এটি ভালো জায়গা, তবে দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের জন্য কিছু সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।
- বার্ষিক গড় আয় : ১,৬৯,৭৫৬ ডলার
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্য তার বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিস্তৃত চাকরির বাজারের জন্য সুপরিচিত। বিশেষ করে লন্ডন শহরটি আন্তর্জাতিক পেশাজীবীদের অন্যতম আকর্ষণ। এখানে প্রবাসীদের জন্য সামাজিক সুবিধা, পেশাগত নেটওয়ার্ক এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। তবে ব্রেক্সিটের পর কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেলেও, এখনও এটি বিশ্বের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
বাহরাইন
উপসাগরীয় অঞ্চলের শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল দেশ হিসেবে বাহরাইন এখন অনেক দক্ষ কর্মীর পছন্দের জায়গা। তুলনামূলক কম খরচে বসবাস এবং করমুক্ত আয় এটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ প্রবাসীদের জন্য সুবিধাজনক। ছোট আকারের হলেও, এখানে ক্যারিয়ারে উন্নতির সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে আইটি ও ব্যাংকিং খাতে।
বিদেশে প্রবাসী জীবন মানেই শুধু ভালো আয় নয়, বরং একটি নিরাপদ, সম্মানজনক ও উন্নয়নমুখী জীবন গড়ার সম্ভাবনা। এইচএসবিসির জরিপ অনুযায়ী যেসব দেশ তালিকার শীর্ষে রয়েছে, সেগুলো শুধু উচ্চ বেতন নয়— দিচ্ছে উন্নত কর্মপরিবেশ, ক্যারিয়ার উন্নয়নের সুযোগ, এবং ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য।
তবে, কোন দেশ কার জন্য সেরা হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তির লক্ষ্য, পেশা, অভিজ্ঞতা ও জীবনধারার উপর। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে প্রতিটি দিক ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া জরুরি।
বিশ্ব অনেক বড়, আর সম্ভাবনার পথ আরও বড়— তাই সঠিক তথ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই হতে পারে জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্যের চাবিকাঠি।