নাসির উদ্দিন হায়দার :: আজ থেকে ১৮ বছর আগে ১৯৯৫-৯৬ সালে যখন চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী আর ভোরের কাগজের ক্রোড়পত্র ‘চলমান চট্টগ্রামে’ লিখতে শুরু করি তখন কিন্তু সাংবাদিক হওয়ার কোনো স্বপ্ন ছিল না আমার। ১৯৯৮ সালে প্রদায়ক হিসাবে যুক্ত হলাম প্রথম আলোতে। টানা ছয় বছর কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার হিসাবে কাজ করার পর ২০০৪ সালে চাকরি পেলাম প্রথম আলোতেই, হয়ে গেলাম সাংবাদিক। অনন্য, অতুলনীয় সম্পাদক মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) দেখা পাওয়া, তার সাথে বসতে পারা কিংবা কথা বলা আমার মনোজগত বদলে দেয়, তার হাত ধরে ভালো সাংবাদিক, বড় সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন তখন চোখে-মুখে। এরপর সাড়ে সাত বছর আলোকিত ওই কাগজটিতে কাজ করে নিজেকে প্রস্ফুটিত করেছি। নিজের যোগ্যতা প্রমাণে কিংবা নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে সিনিয়র সহকর্মীদের ভূমিকার কোনো বিকল্প নেই এবং প্রথম আলোতে আমি তা পেয়েছিলাম।
যখন পেশাদার সাংবাদিকতা শুরু করি তখন চোখে কত স্বপ্ন ছিল, মনে কত সুর ছিল। সাংবাদিকতা আসলে শুধু পেশা নয়, এটা নেশা। সবচেয়ে বড় কথা এটি একটি মর্যাদাশীল পেশা। এখানে অর্থেও চেয়ে সম্মানটা অনেক বড়। সবচেয়ে বড় কথা সাংবাদিকতায় মানুষের কথা কথা বলা যায়, মানুষের কাছে যাওয়া যায়।
কিন্তু এখন সাংবাদিকের নাম শুনলে মানুষ নাক ছিটকায়, সামনে সালাম দিলেও পেছনে গালি দেয়। সবাই জানে কিছু সাংবাদিক নামধারী টাউটের কারণে গোটা সাংবাদিক সমাজকে আজ এই অপবাদ মাথা পেতে নিতে হচ্ছে।
আবার মূলধারার কিছু সাংবাদিকও নানা অনৈতিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত, যাদের অনেককে আমরা একদা আইডল মানতাম।
এই সময়ে সাংবাদিকতার সবেচেয়ে নেগেটিভ দিক হলো, জব সিকিউরিটি না থাকা। হালে সংবাদপত্রগুলো করপোরেট সেবাদাস হয়ে উঠছে, এখানে মানবিকতার স্থান নেই। অথচ সাংবাদিকরাই শেখান সংবাদপত্র একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান। এখন সংবাদপত্রে কথায় কথায় চাকরি যায়। অনেক সংবাদপত্র কাগজ-কালিতে গণতন্ত্রের জয়গান করে, কিন্তু নিজের হাউসে গণতন্ত্র চর্চার লেশ মাত্র নেই।
একজন সাংবাদিক বছরের পর বছর তার মেধা আর শ্রম দিয়ে যে পত্রিকাটি পাঠকপ্রিয় করায় ভূমিকা রেখেছেন হঠাৎ করে তাকে ছাঁটাই করা হয়। কর্তৃপক্ষ একবারও ভাবে না, মানুষটা কোথায় যাবে। আজ আবেদ খানের মতো বরেণ্য সাংবাদিক বেকার, গোলাম সারোয়ারও ছিলেন কিছুদিন। মিনার মাহমুদ তো একবুক হতাশা নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সারা দেশে অনেক মিনার মাহমুদ আছেন, যারা একটি বয়সে এসে স্ত্রী-সন্তানকে মুখ দেখাতে পারেন না, জীবনে এক টাকা সঞ্চয় নেই, নেই চাকরিটাও। আবার কিছু বাঘা সাংবাদিক মালিক-সম্পাদকের সাথে আপস করে চাকরি করে যাচ্ছেন বিড়াল হয়ে। অনেকে আবার অন্য লাইন ধরেছেন। সাংবাদিকরা চাইলে এবং কৌশল জানলে টাকার কুমির হতে পারেন অল্প সময়ে। ঢাকা-চট্টগ্রামের এ রকম টাকার কুমির অনেক সাংবাদিককে আমরা চিনি।
সংবাদপত্রে করপোরেট কালচারের কারণে কর্মীদের বেতনভাতা বেড়েছে অবিশ্বাস্য, কিন্তু সেই সাথে বেড়েছে নিজেদের মধ্যে গুতোগুতি, ল্যাং মারার সংস্কৃতি। একজন এবিএম মুসা সন্তানের মতো আগলে রেখে যেভাবে একজন আতাউস সামাদ সৃষ্টি করেছেন, এটা এখন কল্পনা করা যায় না।
আর এখন আর এক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সব হাউসে কিছু প্রশাসক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক বসানো হয়েছে যারা সাংবাদিক হায়ার করেন আবার ঠুনকো কারণে তাদের ফায়ার করেন। তাদের বলা যায় করপোরেট কিলার। তারা চলেন মালিক-সম্পাদকের চোখের ইশারায়, সাংবাদিকদের সাধ্য কি তাদের টিকিটি স্পর্শ করে!
আজ ৩৫ বছর বয়সে এসে ১২ বছর পেশাদার সাংবাদিকতার পর মনে হচ্ছে, ‘এই সাংবাদিক-জীবন লইয়া আমি কি করিব?’ সৎ সাংবাদিকতা করে শেষ জীবনে ভিখারী হব? না টাকা পয়সা কামাই করে আখের গুছাব?
কিন্তু সব কাজ সবাই পারে না, দুর্নীতি করতেও বিশেষ যাগ্যতা লাগে।
শেষ কথা-সাংবাদিকতার মর্যাদা আর সম্মানে মন ভারে না, তলার পেট শুন্য বলে।
নাসির উদ্দিন হায়দার : লেখক ও সাংবাদিক
মন্তব্য যুক্ত করুন