বার্তাবাংলা ডেস্ক :: প্রেমের সম্পর্ক এখন গড়ে উঠছে অনলাইনে, ফেসবুকে। কিছুদিন আগেও প্রেমের প্রথম ধাপ মানেই ছিল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে, চত্বরে, আড্ডার ফাঁকে কিংবা নির্জন কোনো এক পরিসরে দুরু দুরু বুকে পছন্দের প্রিয় মানুষটিকে জানিয়ে দেওয়া মনের কথাটি৷ কখনো লজ্জায় মুখোমুখি আবার কখনো বা ছোট্ট চিরকুট। তারপর হয়তো ক্যাম্পাস ছেড়ে পার্ক বা কফি শপ। প্রেম বলতে তখন ছিল ঈদ এলে প্রিয় মেয়েটির বাড়ির সামনে গিয়ে অকারণ হাঁটাহাঁটি বা বারান্দায় তাকে দেখে আড়চোখে তাকানো। তারপর অভিভাবকদের চোখ এড়িয়ে মন দেওয়া-নেওয়ার পালা। কিন্তু সময় বদলেছে। এখনকার প্রজন্ম প্রেম করছে ফেসবুকে। এখন সম্পর্ক ভাঙা-গড়া সবই নির্ভর করছে একটি মাউসের ক্লিকের ওপরে। নিমেষে বদলে যাচ্ছে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস। কখনো সিঙ্গেল থেকে ইন অ্যা রিলেশনশিপ আবার কখনো এনগেইজড থেকে সিঙ্গেল। মার্কিন মনোবিদেরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, রোমান্সের দুনিয়ায় এখন ফেসবুক প্রেম বাড়ছে আর বাড়ছে অনলাইন ডেটিং৷ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রয়টার্স। ডেক্সটপ, ল্যাপটপ পেরিয়ে মুঠোফোনের অ্যাপ্লিকেশনের সুযোগ অনলাইন সাইটগুলোতে সক্রিয় রাখছে নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের। ব্যস্ত সময়ের চাপ কাটিয়ে পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের সময়-সুযোগ কমে গেছে বলেও হয়তো ফেসবুক প্রেমে জড়িয়ে পড়ছে অনেকেই। লাখ লাখ প্রোফাইল থেকে খোঁজ চলছে একটা সুন্দর মুখের।
অনেকে আবার প্রতারণা বা নিছক মজার উদ্দেশ্যেও খুলছেন ভুয়া ফেসবুক প্রোফাইল। অনেকেই আবার সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে বাঁচতে বন্ধুত্বের উষ্ণতা খুঁজছেন ফেসবুকে।
তাঁদের ফেসবুক প্রেম
কোনো এক ঈদের দিন ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটির সময় ‘প্রিয়া’ নামের একটি সুন্দর মেয়ের প্রোফাইল চোখে পড়েছিল বেসরকারি অফিসের তরুণ কর্মকর্তা রাজীবের। চোখের দেখা থেকে ভালো লাগা। তারপর ‘প্রিয়া’ নামের অচেনা সেই ফেসবুকে প্রোফাইলে তিনি পাঠিয়েছিলেন বন্ধুত্বের অনুরোধ। প্রিয়ার প্রোফাইলে দেওয়া তথ্যে কোনো গড়বড় পাননি রাজীব। সেদিনই ফেসবুকে বন্ধুত্বের আহ্বানে সাড়া আসে প্রিয়ার কাছ থেকে। এরপর থেকে সময় পেলেই দুজন চ্যাটিং আর নানা আলোচনা। একসময় প্রেমের নানা কথাও আলোচনা করেন তাঁরা। এক মাসের মধ্যেই যেন দুজনের মধ্যে দানা বাঁধে গাঢ় প্রেম। এরপর আসে সামনা-সামনি দেখা করার অনুরোধ। কিন্তু সেই দেখা আর হয়নি। তিন মাস পর একদিন রাজীব জানতে পারেন, তাঁর খুব কাছের এক ছেলে বন্ধু ‘প্রিয়া’ নাম দিয়ে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে তাঁর সঙ্গে প্রেমের এ অভিনয় করেছে। খুব বিষণ্ন হয়ে মুষড়ে পড়েন রাজীব।
এদিকে প্রায় একই সময় ফেসবুকে তাঁর এক ছেলেবন্ধুর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন তিথি নামের এক তরুণী। সম্পর্কের একপর্যায়ে তিথি যখন জানতে পারলেন যে তাঁর ছেলেবন্ধু শুধু তাঁর সঙ্গেই নয়, পরিচিত অনেক মেয়ের সঙ্গেই ফেসবুকে প্রেমের সম্পর্কের পর্যায়ে রয়েছে, তখন তাঁদের সম্পর্ক আর বেশিদূর গড়ায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবে পা দিয়েছেন শম্পা। অন্তর্মুখী শম্পা ফেসবুকে শাওন নামের একজনের প্রোফাইলে দেওয়া তথ্যগুলো দেখছিলেন। শাওনের তোলা সাম্প্রতিক ছবিগুলো তাঁর খুব পছন্দ হয়ে যায়। এরপর ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়েছে তাঁদের। মুঠোফোনে এখন নিয়মিত কথা বলেন তাঁরা। এবার ঈদে মুখোমুখি দেখা করার কথা রয়েছে তাঁদের। অবশ্য সামনা-সামনি না দেখেও সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ায় শম্পা খানিক চিন্তিতও বটে।
কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফেসবুকের এই প্রেম শেষ পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। ফেসবুকে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া প্রসঙ্গে তৌহিদ জানিয়েছেন, ফেসবুকের সম্পর্ক যেন ঝড়ের গতিতে তৈরি হয় আর ঝড়ের গতিতেই ভেঙে যায়। এ ধরনের সম্পর্ক ভেঙে গেলে প্রথম দিকে খুবই কষ্ট আর বিষণ্ন লাগে। তবে সেরে উঠতেও বেশি সময় লাগে না। তাই বিষয়টি সিরিয়াসলি নেওয়া কখনো ঠিক নয়। (ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)
তবুও প্রেমের ভরসা ফেসবুক
বিষণ্ন আর হতাশার মধ্যে ফেসবুক যেন আরও বেশি করে কাছে টানে অনেককেই। আজকের এই অতিব্যস্ত জীবনে অনেকেই ফেসবুকে খোঁজেন দম ফেলার ঠাঁই। অনেকে আবেগে বসিয়ে দেন তাঁদের স্ট্যাটাস, ব্যক্তিগত ছবি; আবার অনেকেই খুঁজে ফেরেন প্রিয় কোনো মুখ। সামনাসামনি যে কথা বলে উঠতে পারা যায় না, চ্যাটে সেই কথাগুলো কত সহজে বলে ফেলা যায়৷ কারও সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চাইলে, তাকে বন্ধু তালিকার বাইরে পাঠিয়ে বা ব্লক করে সম্পর্কে অনাগ্রহের কথাও জানানো সহজ। এখন যেন ফেসবুক হয়ে উঠেছে পরিচিত আর অপরিচিত ১০০ কোটি মানুষের মিলনস্থল।
অবশ্য এ বিশাল জনসংখ্যার সাইটটির সবগুলো কিন্তু আসল প্রোফাইল নয়। এ ক্ষেত্রে অনেকেই ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে পেতে রেখেছে প্রতারণার ফাঁস। গলায় ঝুলে পড়লেই বিপদ। ফেসবুকে প্রতারণার খবর আমরা এখন হরহামেশাই শুনতে পাই। তাই সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে অনলাইন যোগাযোগে সব সময়ই ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। গবেষণায় জানিয়েছেন, ইন্টারনেটে জীবনসঙ্গী খুঁজে দেয়ার সাইটগুলোতে ৮০ শতাংশ মানুষই তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বাড়িয়ে বলছে অথবা সত্য গোপন করছে।
তাই অনলাইনে অচেনা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব জমানোর আগে সাবধান হোন৷ ফেসবুকে প্রেমে পড়ার আগেই তাই অপর পক্ষের সব তথ্য সঠিক কি না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হোন। ব্যক্তিগত সব তথ্য শেয়ার করার আগে সাবধান থাকুন। সহজেই কাউকে ফোন নম্বর বা বাড়ির ঠিকানা দেবেন না। একই ব্যক্তি নাম, ছবি, পরিচয় ভাঁড়িয়ে একাধিক প্রোফাইল চালান। মিষ্টি কথায় আলাপ জমিয়ে তাঁদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। ফেসবুকে কাউকে ভালো লাগলে আগে তাঁর প্রোফাইলে কিক করুন। দেখে নিন কোনো কমন ফ্রেন্ড আছেন কি না। তাঁদের কাছ থেকে মানুষটি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন। আলোচনার সময় তাঁর বিষয়ে বিস্তারিত জানুন। দেখা করতে চাইলে কখনো নির্জন স্থানে যাবেন না। আপনার ফেসবুক সম্পর্কের কথা ঘনিষ্ঠ কাউকে জানিয়ে রাখবেন। অশালীন প্রস্তাব পেলে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিন।
বহুজাতিক মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান ইউরো আরএসসিজির সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠছে। জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নর্ম ইউস্তিন বলেন, ‘আমাদের বাস্তব জীবন এবং অনলাইন জীবন পরস্পর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে যে লোকজনের সঙ্গে আমরা মিশি আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে (ফেসবুক-টুইটার) আমরা যে আচরণ করি, তা বাস্তবে আমাদের আচরণকেও প্রভাবিত করছে। তা ভালো-মন্দ যা-ই হোক না কেন।’
মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা জানিয়েছেন, আমাদের সামাজিক প্রবাহে ভূমিকা রাখছে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো, কিন্তু নারী-পুরুষের একান্ত সম্পর্কে অবিশ্বাস, ঈর্ষা আর সন্দেহের গভীর ফাটলও ধরাচ্ছে।
শারীরিক ও মানসিক প্রতারণা থেকে শুরু করে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, সংসার ভেঙে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটার পেছনে ফেসবুকের বড় ভূমিকা রয়েছে। ফেসবুক থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ঈর্ষা আর এ ঈর্ষা থেকে সঙ্গীর সঙ্গে শুরু হচ্ছে বাগবিতণ্ডা।
অপরিণত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরামর্শ হিসেবে গবেষক ক্লেটন জানিয়েছেন, সম্পর্ক পরিণত হওয়ার আগে অতিরিক্ত সময় ধরে ফেসবুক নয়। কারণ, এ সময়টা হচ্ছে পরস্পরকে নতুন করে জানার।
সামাজিক অন্তর্জালের মায়াজালে আটকে প্রতারণার শিকার হওয়ার প্রতিষেধক হিসেবে সামান্য সচেতনতার পরামর্শই দিচ্ছেন মনোবিদ ও গবেষকেরা। সূত্র: প্রথম আলো।