বার্তাবাংলা ডেস্ক :: চারদিকে আজ ঈদের খুশি। আনন্দ-উত্সব। এ জন্য কয়েক দিন ধরে চলেছে কত না আয়োজন। কেনাকাটার ধুম পড়েছিল আরও আগে। শহর-বন্দর-গ্রাম সবখানেই উছলে পড়ছে ঈদের আনন্দ। ধনী-গরিব নেই ভেদাভেদ। জাতপাতেরও নেই বৈষম্য। দুনিয়ার সব মানুষের জন্য খুশির বারতা নিয়ে এসেছে ঈদুল ফিতর। আজ থেকে কয়েক শ বছর আগেও কি এই জনপদে এভাবে হাজির হতো ঈদ?
অতীতে এ অঞ্চলে মুসলমানদের ঈদুল ফিতর উদযাপন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা সমগ্র ১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘আজ আমরা যে ঈদের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করি বা যে ঈদকে দেখি আমাদের একটি বড় উত্সব হিসেবে, তা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য মাত্র।’
বাংলায় বড় কোনো উত্সব হিসেবে ঈদুল ফিতর পালিত না হওয়ার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন মুনতাসীর মামুন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ইংরেজ শাসনামলে এ অঞ্চলে সবচেয়ে ধুমধামে উদযাপিত হতো ক্রিসমাস বা বড়দিন। এই উত্সবের জন্য ছুটি বরাদ্দও ছিল বেশি। কলকাতার বাইরে শহর, মফস্বল বা গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ উত্সবের কোনো যোগসূত্র ছিল না। এরপর জমকালোভাবে উদযাপিত হতো দুর্গাপূজা। ঈদের থেকে পূজায় সরকারি ছুটি ছিল বেশি। তখন মুসলমান চাকরিজীবীরা ঈদের ছুটি বাড়ানোর আবেদন করলেও এতে কাজ হয়নি। তা ছাড়া সেই সময় ঈদকে উত্সবে পরিণত করার মতো সামর্থ্যও গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমানের ছিল না।
মুসলমানদের প্রধান উত্সব হিসেব ঈদ উদযাপন না হওয়ার আরেকটি কারণ বিশুদ্ধ ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা।
তবে সাধারণ মুসলমানদের তুলনায় বহিরাগত মুসলমানেরা বেশ উত্সাহ নিয়েই ঈদ উদযাপন করতেন। এ সম্পর্কে মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে আগত মুঘলরা বাংলার সাধারণ মানুষের তুলনায় ইসলাম সম্পর্কে জানতেন বেশি। কিন্তু বিশুদ্ধ ধর্ম পালনে তাঁরা উত্সাহী ছিলেন না। ধর্মে আছে ঈদ মানে খুশী। সুতরাং, রমজান থেকেই মোটামুটি তারা সচেষ্ট থাকতেন যতোটা পারা যায় আনন্দ নিংড়ে নিতে। সুরা পানেও এ সময় তাদের অনাগ্রহ ছিল না।’
ঢাকায় ঈদ উদযাপনের সবচেয়ে পুরোনো তথ্য পাওয়া যায় আজাদ হোসেন বিলগ্রামীর ‘নওবাহারই মুর্শীদ খান’ গ্রন্থে। এ বই অবলম্বনে ঐতিহাসিক আবদুর রহিম জানিয়েছেন, মুসলমানেরা সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদে শোভাযাত্রা করে ঈদগাহে যেতেন। অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মুক্ত মনে টাকা-পয়সা ও উপহারসামগ্রী পথে পথে ছড়িয়ে দিতেন।
ঈদ পালনের এই বিবরণের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘এ বর্ণনা থেকে মনে হতে পারে, দু’তিনশো বছর আগে ঢাকায় বোধ হয় খুব ধুমধামের সঙ্গে ঈদ পালিত হতো। আসলে তা ঠিক নয়। এ বর্ণনাটির পরিপ্রেক্ষিত সঠিক নয়।’
এই দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণে যাদুনাথ সরকারের একটি বিবরণ উল্লেখ করেছেন মুনতাসীর মামুন: ‘দ্বিতীয় মুর্শীদ কুলি খাঁর সময় (১৭২৯) জয় করা হয়েছিলো ত্রিপুরা। ২৯ রমজান নবাব এ খবর পেয়ে এতো উল্লসিত হলেন যে, তিনি যেন দুটি ঈদ পালন করছেন। ঈদের দিন, এ কারণে তিনি মীর সৈয়দ আলী ও মীর মোহম্মদ জামানকে আদেশ দিলেন গরীবদের মধ্যে এক হাজার টাকা বিতরণ করতে। ঢাকা কিল্লা থেকে এক ক্রোশ দূরে ঈদগা যাবার পথে রাস্তায় ছড়ানো হয়েছিল মুদ্রা।’
যাদুনাথ সরকারের এই বিবরণের আলোকে মুনতাসীর মামুনের সিদ্ধান্ত, ‘ঈদের দিন যে হৈ চৈ টুকু হতো তা বহিরাগত উচ্চপদধারী বা ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ সবের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ছিল যোজনব্যাপী ব্যবধান।’ঢাকার ঈদ উত্সব মিছিলের দৃশ্য।আনুমানিক ১৮২০ সাল।জলরং।বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর প্রকাশিত পোস্টকার্ড।
এরপর এই শতকের আগের ঈদের বর্ণনা তেমন আর পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন মুনতাসীর মামুন। তবে তিনি উল্লেখ করেন, মুঘলরা ঈদের গুরুত্ব দিতেন। ঢাকা, সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শাহী ঈদগাহের ধ্বংসাবশেষ দেখে তা বোঝা যায়। এ রকম একটি ঈদগাহ আছে ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায়।
আ. ম. ম. শরফুদ্দীন অনূদিত মুনশী রহমান আলী তায়েশের ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ গ্রন্থের বরাত দিয়ে ‘ঢাকা সমগ্র ১’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, বাংলার সুবাদার শাহ সুজার আমলে তাঁর আমাত্য মীর আবুল কাসেম ১৬৪০ সালে ওই ঈদগাহটি নির্মাণ করেছিলেন। সুবাদার, নাজিম ও অন্যান্য মুঘল কর্মকর্তারা সেখানে নামাজ পড়তেন। ইংরেজ আমলে ঈদগাহটি ছিল জরাজীর্ণ ও জঙ্গলাকীর্ণ। উনিশ শতকে খুব সম্ভব শেষের দিকে শহরের মুসলমানরা ওই ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তেন। আর সেখানে একটি মেলার আয়োজন করা হতো।
মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘মুঘল আমলে ঈদের দিন ঈদগাহে যেতেন মুঘলরাই, সাধারণ মানুষের স্থান সেখানে ছিল কিনা সন্দেহ। তবে, তায়েশ উল্লিখিত মেলার বর্ণনা থেকে অনুমান করে নিতে পারি, উনিশ শতকের শেষে এবং এ শতকের গোড়ায় ঈদের দিন আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে সাধারণ মানুষ যোগ করেছিল একটি লোকায়ত উপাদান—মেলা।’
‘ঢাকা সমগ্র ১’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আশরাফ-উজ-জামান তাঁর আত্মজীবনীমূলক এক নিবন্ধে ঈদ মেলার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঈদের মেলা হ’ত চকবাজারে এবং রমনা ময়দানে। বাঁশের তৈরি খঞ্চা ডালা আসত নানা রকমের। কাঠের খেলনা, ময়দা এবং ছানার খাবারের দোকান বসতো সুন্দর করে সাজিয়ে। কাবলীর নাচ হ’ত বিকেল বেলা।’ আবদুস সাত্তারও প্রায় একই কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা যে সময়ের কথা লিখেছেন তা সম্ভবত ত্রিশ-চল্লিশের দশক।
এই সময়ে ঈদ উদযাপন সম্পর্কে মুনতাসীর মামুনের পর্যবেক্ষণ, ‘ঈদ সম্পর্কে যে স্বল্প বিবরণ পাওয়া যায়, তা থেকে ধরে নেওয়া যায়, রমজান মাস থেকেই শুরু হতো ঈদের প্রস্তুতি। এ উত্সাহের শুরু হতো রমজানের ঈদের চাঁদ দেখা থেকে। মনে হয়, এটি মুঘল প্রভাবের কারণ এবং তা সীমাবদ্ধ ছিল শহরে বিশেষ করে ঢাকার এবং মফস্বল বা গ্রামের সম্পন্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে।
১৯৪৭-এর আগে, বাংলাদেশে একমাত্র ঢাকায়ই ঈদ যা একটু ধুমধামের সঙ্গে পালিত হতো। ঢাকা ছিল পূর্ববঙ্গের প্রধান ও মুঘল শহর। তাই মুঘল ঈদের প্রভাব ছিল বেশি। তা ছাড়া, এখানে থাকতেন নওয়াব ও অন্যান্য মুসলমান ধনাঢ্য ও শরীফ ব্যক্তিরা। ফলে ঈদ পেতো পৃষ্ঠপোষকতা।’
‘ঢাকা সমগ্র ১’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, একসময় ঢাকায় ঈদের মিছিল হতো। বাংলাদেশের আর কোথাও এ ধরনের মিছিল বের হতো না। এ মিছিল কবে শুরু হয়েছিল, তা জানা যায়নি। তবে খুব সম্ভব অষ্টাদশ শতকে নায়েব-নাজিমদের নিমতলি প্রাসাদে এসে বসবাস শুরু করার সময় থেকে। আর খুব সম্ভব উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকার নায়েব-নাজিমদের বংশ লুপ্ত হয়ে গেলে এই ঈদ মিছিলের সমাপ্তি ঘটে।
মুনতাসীর মামুনের লেখা থেকে জানা যায়, এ শতকের বিশ-তিরিশের দশকে ঢাকায় রমজানের শুরুতেই ঘরবাড়ি, মসজিদ সব সাফ-সুতরো করে রাখা হতো। রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বিকেল থেকেই বড় কাটরা, আহসান মঞ্জিল, হুসেনী দালানের ছাদে ভিড় জমে যেত। আবুয্ যোহা নূর আহমদ তাঁর ‘উনিশ শতকের ঢাকার সমাজ জীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চাঁদ দেখা মাত্রই চারদিক হইতে মোবারকবাদ, পরস্পর সালাম বিনিময় এবং গোলাবাজি ও তোপের আওয়াজ হইতে থাকিত।’
মুঘল, ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান আমলের সঙ্গে বর্তমান ঈদের পার্থক্য সম্পর্কে মুনতাসীর মামুন প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘ঈদের মূল বিষয়টি একই আছে। কিন্তু গত ৪০০ বছরে ক্রমে ঈদের জৌলুস বেড়েছে। মুঘল ও ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলে ঈদ তেমন কোনো ব্যাপার ছিল না। পাকিস্তান আমলে তা একটি অবয়ব পায়। ঈদকে ঘিরে এখন একটি অর্থনীতি তৈরি হয়েছে। ফ্যাশন তৈরি হয়েছে। টেলিভিশনে ঈদ নিয়ে কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হচ্ছে। এমনকি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও ঈদ যুক্ত হয়েছে।’
বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ মুস্তাফা জামান আব্বাসী তাঁর শৈশব ও কৈশরের ঈদ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘তখন ছিল ঈদের সত্যিকারের আমেজ। একটা নতুন কাপড়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম এক বছর। সেই কাপড় কীভাবে রাখব, যাতে ভাঁজ নষ্ট না হয়, অমলিন না হয়, তা নিয়ে কত ভাবনা। যত্নের সঙ্গে জামা-জুতো পরতাম। কুচবিহারে ঈদের নামাজ হতো। মুসলমানদের সঙ্গে কোলাকুলি করার জন্য দল বেঁধে হিন্দুরা ঈদের মাঠে আসত। ঈদের সেমাই ছিল অমৃতের মতো। ঈদের মেলাতে সব ধর্মের লোকজন আসত।’
কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান তাঁর শৈশব ও কৈশরের ঈদের সঙ্গে বর্তমান ঈদের পার্থক্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগে ঈদের বাণিজ্যিকায়ন ছিল না। সম্প্রীতি ছিল। আন্তরিকতা ছিল। এখন আর তেমনটা দেখি না। এখন মানুষের চাহিদা বেশি বেশি।’ সূত্র : প্রথম আলো