খন রঞ্জন রায় :: ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’ …আমাদের সার্থক জাতীয় সংগীত। ফাল্গুন এলেই বাংলা-ভারত উপমহাদেশের মানুষের খাদ্যপণ্যের তালিকা পরিশুদ্ধকরণ হয়। আধ্যাত্মিক মনীষীরা অনন্তকাল থেকে ফলমূল আহার করে আত্মাকে পরিপুষ্ট রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন ফলদায়িনী বৃক্ষের পূজা অর্চনা করে থাকেন। মৃতদেহ সৎকার করা কাজে আমকাঠের প্রয়োজন নির্ধারণ করা আছে। পূজা অর্চনায় যজ্ঞরীতি সমাপন করতে আম্রপল্লব ও আমঢাল আপসহীন ব্যবহারে অপশক্তি উচ্ছেদ চেতনার মজবুত অঙ্গীকার প্রকাশ পায়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকাচারে গ্রীষ্ম কালকে সমাজ মধুমাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার কারণে এ সময়ে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ, লেবু, পেঁেপ, আনারস, পেয়ারা, টেরখই, জামরুল বেল, কদবেল, ডেউয়া, ডেমফল আমাদের জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসাবে সস্মৃক্ত হয়। ইতিমধ্যে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, ফুটপাত গরমের তৃষ্ণা নিবারণী বৈচিত্র্যময় ফলের সমাহারে লোভাতুর আবেশ তৈরি করেছে। সংক্ষিপ্ত সময়ের ফল লিচু। অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যর বিচিত্র স্বাদের কালীপুরের লিচু দুই তিনদিনেই উধাও। আগমন ঘটেছে উত্তরাঞ্চলীয় রসে টসটস লালচে মাংসল লিচুর। হয়তো পাওয়া যাবে সপ্তাহখানেক। এর মধ্যেই অসাধারণ লিচুর নিবেদিতপ্রাণ গৌরবময় স্বাদ অন্বেষণ করে নিতে হবে।
চারহাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ ‘আম’ বর্তমানে ৩৫ রকম স্বাদ, গন্ধ, রস ও জাতের পাওয়া যায়। গোপালভোগ, মালভোগ, ল্যাংড়া, সুন্দরী, ভবানী, চম্পা, দাউনিয়া, সুরম্পা, বৈশাখী, পাঞ্চাছন্দ, সরঙ্গম, সিদুঁরকোটা, বউভোলানী, হিমসাগর, কাজলী, কলাবতি, বিবিপছন্দ ইত্যাদি নামীয় ও দামীয় আম মধু মাসের নামকে স্বার্থক করতে পরিপূর্ণ ভূমিকা পালনে করছে।
ক্যানসার, লিউকোমিয়া প্রতিরোধে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ঔষধি গুণে গুণান্বিত নানান জাত ও পদের আমে ভিটামিন এ, বি ও সি আমাদের প্রাণশক্তির অফুরন্ত দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গেল বছর আমাদের দেশে মোট মৌসুমি ফল উৎপাদন হয়েছে ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার টন। দেশব্যাপী এর উৎপাদনে জমি ব্যবহার হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর। ফলের রাজা খ্যাত আম উৎপাদনে হয়েছে ১০ লাখ টন। জমি ব্যবহৃত হয়েছে ৩০-৩৫ হাজার হেক্টর। দেশে উৎপাদিত আমের ২০-২৫ শতাংশ ব্যবহার হয় জুস উৎপাদন খাতে। এছাড়া সীমিত আকারে আচার, চাটনি, চকোলেটসহ মুখরোচক নানান খাদ্য তৈরিতে ফলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে তৃষ্ণা মেটাতে বিবিধ ফলের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই। এর শরীরতত্ত্বীয় প্রভাব চিকিৎসাশাস্ত্রীয় মহৌষধ হিসাবে আমাদের নিভৃতে কাজ করে। গরমে ভাইরাসজনিত সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা-জ্বরে আক্রান্ত হই। এক্ষেত্রে ভিটামিন ই, পটাশিয়াম, প্রোটিন ও ফ্যাটয্ক্তু ফলমূলের গুণাগুণ মৌসুমি রোগসমূহের প্রতিকারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। মানব দেহের উপকারী উপাদান ভিটামিন বি-৬, ফাইবারকপার, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম পেকটিন ফাইবার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরে জমাকৃত ক্ষতিকর কোলেস্টোরল মাত্রা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। খোশ-পাচরায় নিরাময়যোগ্য ফলের রস ত্বক ফর্সা, সুন্দর হতে সাহায্য করে। স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে, রাতকানা রোগ প্রতিকারে, হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, ওজন কমাতে, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে, ঝরঝরে ফুরফুরে মেজাজ সৃষ্টিতে পরিপক্ক উপাদান রয়েছে মধুমাসের বিভিন্ন ফলে। শরীরের লাবণ্য ফিরিয়ে আনতে জীবন-যৌবন ও বার্ধক্য প্রতিরোধে আম, কাঁঠালের পুষ্টিমান গবেষক, সমাজবিজ্ঞানী আর কৃষিবিজ্ঞানীদের অহংকারের অগ্নিবলয় নির্দ্বিধায় সৃষ্টি করেছে।
শিশু, কিশোর, কিশোরী ও পূর্ণবয়সী নারী, গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের জন্যে দুই তিন কোয়া গ্রীষ্মের দৃষ্টিনন্দন পুষ্টিগুণে ভরপুর তাজা ফল অফুরন্ত শক্তির আধার হিসেবে বিতর্কহীন দুর্নিবার চৈতন্যের প্রত্যাবর্তন ঘটায়। অপরিসীম গুরুত্ব, অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিনিয়োগ বাণিজ্যের সম্ভাবনা বিবেচনায় দেশব্যাপী আমগাছের স্বার্থক জনপ্রিয়তার কারণে এই গাছকে সরকার জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছে। আমের স্বাদ, গন্ধ, রঙ আকার বিবেচনায় মনোলোভা আমাদের এই ফল চাষ শুরু করেছে চীন, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলসহ অনেক দেশ। বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে চাষাবাদ করে বিশ্বব্যাপী আমের প্রধান রপ্তনিকারক দেশ হিসেবে আবির্র্ভূত হয়েছে ভারত। আমরা ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ধারণ করে উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, নাটোর আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত আমকে লালন করছি।
মৌসুমি ফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে লক্ষ্যমাত্রার আড়ালে প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনার অভাবে হাতছাড়া করছি। বঞ্চিত হচ্ছি এর স্বাদ আস্বাদন, পুষ্টিমান রক্ষার দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণ করা থেকে। দুই তিন মাস পরই আর দেখা মিলছে না বাজার সয়লাব হওয়া ভিন্ন মাত্রার দেশীয় ফলমূলের। বাজার তখন দাপটের সাথে নিয়ন্ত্রণ করে আমদানি করা ফরমালিন, কার্বাইড, মিপসিন, মার্শাল, কার্বোফুরান, ইথরিল, ডাই-এলড্রিন কেমিক্যালযুক্ত স্বাদ, গন্ধ, বর্ণহীন বিজাতীয় ফল।
ভাবতে অবাক লাগে অপার সম্ভাবনার এই ফলমূলকে সংরক্ষণ করার কোন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়নি। দুই চারদিন সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থাও নেই। ফলে নষ্ট হয় আমাদের জাতীয় ঐতিহাসিক ফলমূলগুলো। এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়িরা কয়েকদিন না পঁচার ব্যবস্থা করতে মানবস্বাস্থ্যের অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রোফাইল গেনেট, বিএইচএ, হেপটাইল পারাবেন, বিএইচটি, সোডিয়াম নাইট্রেড, সোডিয়াম বেনজায়েট, সালফাইড ইত্যাদির মিশ্রণ ¯েপ্র করছে। তা প্রকাশ্যে অবলীলায়। তরিতরকারি আর সবজি সংরক্ষণে দেশে কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে মাত্র ২৮০ টি, তাও ঢাকা কেন্দ্রীক। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই সমস্ত কোল্ড স্টোরেজও পরিচালিত হয় ম্যানুয়ালি এনালগ পদ্ধতিতে।
দেশের বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক নানান জাত ও স্বাদের মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। সেই সমস্ত এলাকা চিহিৃত করে আম, জাম, আনারস, লিচু, কাঁঠাল, তরমুজ, বাঙ্গি, পেঁপে ইত্যাদির বিষয়ভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ টেকনোলজি শিক্ষা চালু করে দক্ষ লোকবল তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। উপকরণ আমদানি করে বহুজাতিক কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পঁচে নষ্ট হওয়া রোধ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণে মনোযোগী হতে হবে। এইভাবে এলাকাভিত্তিক লিঙ্গ বৈষম্যহীন দেশজ কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
আমাদের ঐতিহ্যের মধুমাসের ফল সংক্ষিপ্ত সময়ের না হয়ে বছরব্যাপী উপভোগ করবো রবীন্দ্রনাথের ‘আমসত্ত্ব’ কবিতার আদলে। সংরক্ষিত ফল মধ্যপ্রাচ্যের গুটিকয়েক দেশ ছাড়াও দূরপ্রাচ্যের দেশে চাহিদা অনুযায়ী টাটকা তরতাজাভাবে রপ্তানি করতে সক্ষম হবো। বর্তমানে ফল রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা চারশত কোটি টাকা না হয়ে চারহাজার কোটি টাকায় উপনীত হবে- এ বিষয়টি আশ্চর্যের নয়, বাস্তবের।
লেখক : পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী
৪৭, মতি টাওয়ার, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
মোবাইল ০১৭১১-১২২৪২৫