মো. আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায় :: ‘মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য, একটিু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না।’ ভূপেন হাজারিকার অমর এই গানের কথা অনেকেরই জানা। গানের এই কলিটি আপন মহিমায় মূর্তিমান হয়ে উঠেছিল সাভারের ‘রানা প্লাজা’ ভবন ধসের ঘটনায়। গত কয়েকদিন ধরে সারাদেশের উদ্বিগ্ন মানুষের দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সাভারের ধসে পড়া এই ভবনটির ওপর। একটি ভবন যে এভাবে ধসে পড়তে পারে এটা কেউ কখনও কল্পনাও করেনি। শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধার অভিযান চলছে। অনেকের হাতে মাইক। তারা মাইকে বলছেন, একটা অক্সিজেন, সিলিন্ডার প্রয়োজন। মুহুর্তেই তা হাজির করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কিছুক্ষণ পরপর ঘোষণা- ড্রিল মেশিন, হাইড্রোলিক জগ, হেলমেট, স্যালাইন পানি, খালি বস্তা, জেনারেটরের পেট্রোল, টর্চলাইট, স্ক্রু ড্রাইভার, রড কাটার, হাইড্রোলিক প্লায়াসৃ, হ্যান্ড গ্লাভস, চাকু, পানি, রুটি, বিস্কুট, বালতি ইত্যাদি।
সাধারণ ছেনি, হাতুড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক এক করে জীবিত মানুষ বের করে আনে মৃত্যুপুরী থেকে, কয়েক ঘন্টার মাঝে হাজার হাজার ব্যাগ রক্ত জোগাড় হয়ে যায় আহতদের জন্য, ভেঙে পড়া ধ্বংসস্তুপের পাশে সেই স্তুপের চেয়েও বড় স্তুুপ জমে যায় খাবারের। যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে ছুটে আসে প্রত্যেকে, উদ্ধারকারী নিজের জীবিত মানুষ উদ্ধারের নেশায় ভুলে যায় উদ্ধার করতে গিয়ে তার নিজের আহত পা থেকেও ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। দেশের সব দোকান খালি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে নিয়ে আসে উৎসাহী ব্যক্তি আহতদের অক্সিজেন দেবে বলে, হামাগুড়ি দিয়ে নড়বড়ে ধ্বংসস্তুুপের নিচে ঢুকে যায় নাম না জানা তরুণ, পচাগলা লাশ পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জীবনের খোঁজ করে চলে সাধারণ মানুষ, একজন শাহীনাকে বাঁচাতে ঘন্টার পর ঘন্টা সাধরণ মেশিন দিয়ে কংক্রিট কেটে চলে। ১৭ তম দিনে অলৌকিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ উদ্ধার সম্ভব হয় তরুণী রেশমাকে। উদ্ধারকারীরাসহ টিভির সামনে লাখ লাখ মানুষ প্রার্থনা করে যেন সে ঠিকমতো উদ্ধার হতে পারে।
দেশ-বিদেশের কোটি কোটি উদ্বিগ্ন মানুষকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবগত করার কাজটি করেছেন সাংবাদিকেরা। অকল্পনীয় হৃদয়বিদারক ও বীভৎস দৃশ্য তাঁরা নিজেরা অতি কাছে থেকে দেখেছেন। হাত-পা বিচ্ছিন্ন মানুষ, বিমের চাপায় চ্যাপ্টা মৃতদেহ, অন্ধকূপে সেলাই মেশিনের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্ত-আকুতি, এক ফোঁটা পানি ও অক্সিজেনের জন্য তাদের নিস্তেজ কণ্ঠস্বর, তাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন ও নিজের কানে শুনেছেন।
২০০৫ সালে সংঘটিত স্পেকট্রাম ট্র্যাজেডির পর জরুরি উদ্ধার কাজ তৎপরতায় আমাদের অদক্ষতা এবং অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জামের প্রকট অভাব ধরা পড়ে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ডিসিসি ইত্যাদি প্রায় কোন প্রতিষ্ঠানেরই যে কোন দুর্ঘটনায় জরুরি উদ্ধার কাজ ও তৎপরতা চালানোর মত হালকা ও ভারি সরঞ্জাম নেই। নৌপথের পরিস্থিতি আরও খারাপ। এক্ষেত্রে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল স্বেচ্ছাসেবক দলের অভাবও প্রকটভাবে চোখে পড়ে। পুরান ঢাকার শাখারীবাজারে ভবন ধস, তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, দাহ্য পদার্থের গুদামে আগুন, ফিনিক্স ভবন ধসসহ একাধিক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। ভবন ধসে অথবা আগুনে পুড়ে অসহায় মৃত্যুবরণ করেছেন কয়েকশ আদম সন্তান। সর্বশেষ রানা প্লাজা ধসের ভয়াবহ ও ভয়ংকর ট্র্যাজেডি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ব্যাপক আকারের প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূরে থাক, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনাও আমরা মোকাবেলা করতে পারি না। দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা মোকাবেলায় অটুট ও অদম্য মনোবলের অভাব নেই আমাদের। অভাব শুধু অত্যাধুনিক হাল্কা ও ভারি যন্ত্রপাতি ও শিক্ষা প্রশিক্ষনের।
গোল্ডফিশ অ্যাকুয়ারিয়ামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে যেতেই আগের স্মৃতি ভুলে যায়। ‘গোল্ডফিশের এ গল্পই বোধহয় আমাদের চলমান সমাজের জন্য প্রযোজ্য হয়ে গেছে। আগের দুর্ঘটনার নির্মমতা কিছুক্ষনেই চাপা পড়ে যায়। তাজরিণ কারখানায় কাজ করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে শত শত জীবন। মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ১১০ টি। সেই ঘটনার পর কয়েক দিন বিষয়টি নিয়ে খুবই আলোচনা হয়েছে, সংবাদপত্রে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। তারপর নতুন ইস্যু আসার পর প্রায় সবাই ভুলে গেছে তাজরীন ট্রাজেডির কথা।
খ্রিষ্টপূর্ব ২২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া প্রদেশে একটি স্ট্যাচু ভেঙ্গে ২০ হাজার, ২৭ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যের ফিদানায় মুক্তমঞ্চ ধসে ১৩ হাজার মানুষ নিহতের ইতিহাস বড় ট্র্যাজেডি হিসাবে লিপিবদ্ধ আছে। হাল আমলে ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের স্যামপুং ষ্টোরের ভবন ধসে নিহত হয়েছিল ৫০২ জন। আর সাভারের ‘রানা প্লাজায়’ এ লেখা পর্যন্ত (১০-০৫-১৩) উদ্ধার হয়েছে ১১১৫ জন হতভাগ্যের মৃতদেহ। এটি ভবন ধসে মৃতের বিশ্ব রেকর্ড।
উদ্ভূত পরিস্থিতি ও বিপর্যয় হয়তো আমরা ‘গোল্ডফিসের’ মতোই ভুলে যাব। এরপরও বাঙালি সংস্কৃতি এবং সহজাত মমত্ববোধই আমাদের বড় ভরসা। আমরা আতœশক্তি সংহতিবোধ ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর এবং এটাকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে পারলে যে কোন বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব।
উদ্ধার কাজে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের ভূমিকা জাতিকে হতাশ করেছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে বীরত্বগাঁথা মহাকাব্য রচনা করেছে, তার ছিটেফোঁটাও দেখাতে পারেনি এই পেশার লোকেরা। অন্যদিকে জরুরি প্রয়োজনে টস লাইট, ছেনি, শাবল, করাত, অক্সিজেন সিলিন্ডারের মত টুকিটাকি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলোর ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শুধুমাত্র চাকুরি রক্ষার খাতিরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছেন তারা। জাতির প্রতি পেশাগত কোন কর্মদক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
অবাকের বিষয় বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে কর্মরত ৫৫০৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশে কিংবা বিদেশে এ সংক্রান্ত প্রযুক্তিবিদ্যায় পূর্ব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নেই। বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স যন্ত্রপাতি সম্পূর্ণভাবে বিদেশে থেকে আমদানি নির্ভর। অর্থের অভাবে নতুন আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি না করে পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে অনেক ক্ষেত্রে উদ্ধার কার্যক্রম বিঘœ ঘটে। দেশে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স যন্ত্রপাতি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ইনস্ট্রুমেন্টমেকিং ও ম্যানটেইনেন্স প্রযুক্তিবিদ প্রশিক্ষণের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি।
একটি উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে হলে নিজেদের নিরাপত্তা বলয় নিজেকেই সৃষ্টি করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ব্যবস্থাপনায় এনালগ কর্মকাণ্ড বাতিল করে ডিজিটাল করেতে হবে। এ ব্যাপারে ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ নিন্মোক্ত ৮ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে।
১. সরকারি, আধা-সরকারি, পুলিশ, সামরিকবাহিনী, বেসরকারি, হাসপাতল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে শিক্ষাপ্রাপ্ত টেকনোলজিস্ট নিয়োগনীতি প্রণয়ন ও নির্দেশনা প্রদান করা। ২. ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বিহীণ কর্মরত সকল চাকরিজীবীদের বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করে ডিপ্লোমা ইন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজিতে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের নিয়োগ নির্দেশনা প্রদান। ৩. চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ল্যান্ড ফায়ার সার্ভিস, রিভার ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ইনস্ট্রুমেন্ট মেকিং ম্যানটেইনেন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চালু করা। ৪. সরকারি, সিটি কর্পোরেশন, বেসরকারি উদ্যোগে জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নে একাধিক ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সহযোগিতা ও নির্দেশনা প্রদান করা। ৫. তৃণমূলে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা নীতি সহজ ও সরলীকরণের লক্ষ্যে ব্রিটিশ পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্ন মতাদর্শের ডিপ্লোমা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী ৭ টি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা শিক্ষা কার্যক্রম পৃথক করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রশাসনিক বিভাগে স্বাধীন স্বতন্ত্র ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠা নির্দেশনা প্রদান করা। ৬. উন্নত বিশ্বের মতো ‘বিভাগীয় ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড’ প্রদত্ত ডিপ্লোমা ইন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ডিগ্রিপ্রাপ্তদের নিয়োগ এবং উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা নির্দেশনা প্রদান করা। ৭. উপজেলার বিসিক শিল্পনগরী, জেলা, বিভাগীয় ভারী শিল্পনগরী, ইপিজেড এ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ইনস্ট্রুমেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য ডিপ্লোমাধারীদের সহজ শর্তে প্লট বরাদ্দ ও ব্যাংক ঋণ প্রদানের নির্দেশনা। ৮. (ক) বাংলাদেশে প্রস্তুত ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স যন্ত্রপাতি অধিদপ্তর, শিল্প-কারখানা, হাসপাতালে ব্যাপক সংযোগ ঘটানো। (খ) বাংলাদেশে প্রস্তুুত যন্ত্রপাতি বিদেশে রপ্তানি প্রদানে নির্দেশনা। উপরোক্ত দফাসমূহ বাস্তবায়ন করলে জাতি ট্র্যাজেডি উত্তরণ নির্ভাবনার প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে।
মো. আবুল হাসান, সভাপতি
খন রঞ্জন রায়, মহাসচিব
ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ।
৪৭, মতি টাওয়ার, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
০১৭১১ ১২২৪২৫, ০১৮২০ ১৩০০৯০
Email – khanaranjanroy@gmail.com