ফেলে দেওয়া বোতলকে কাজে লাগিয়েই ঘর ঠান্ডা রাখার দুর্দান্ত এক কৌশল উদ্ভাবন করেছেন আশীষ পাল। সেই উদ্ভাবন বাস্তবে রূপায়ণ আর তার সুফল গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে আশীষের সঙ্গে এককাট্টা হয়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে। সঙ্গে আছে গ্রামীণ-ইন্টেল। বাতাস শীতল করার এই যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইকো-কুলার’ বা পরিবেশবান্ধব কুলার। গ্রামের সাধারণ মানুষ বিদ্যুৎবিহীন এই কুলার ব্যবহার করে ঘরের তাপ কমাতে পারেন স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ ডিগ্রি সেিন্টগ্রেড পর্যন্ত। পরিবেশবান্ধব এই কুলার তৈরির উপকরণও মেলে হাতের নাগালে। এরই মধ্যে দেশের বাইরেও এই উদ্ভাবন সাড়া ফেলেছে।
আশীষ পালের বলছিলেন ‘কয়েক বছর আগে ভারতের রাজস্থানের এক হাওয়া মহলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সে মহলের একটি ব্যাপার আমাকে খুব ভাবিয়েছে, মহলের ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাস ঢুকে কীভাবে ভেতরটা ঠান্ডা হয়। সে সময় কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। তবে তখন থেকেই বিষয়টি মাথায় ঘুরতে থাকে।’
প্রতিদিনের ব্যস্ততায় দিন কাটে। বিষয়টি নিয়ে আর বেশি দূর এগোনো হয় না আশীষ পালের। তবে একদিনের এক ছোট ঘটনা এনে দেয় আলোর সন্ধান। কী সে ঘটনা? ‘একদিন বাসায় আমার মেয়েকে পদার্থবিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন এক শিক্ষক। চাপের ফলে গ্যাস কীভাবে শীতল হয় এই বিষয় নিয়েই তিনি কথা বলছিলেন। বিষয়টি আমাকে দারুণ উৎসাহী করে তোলে। এত দিন ধরে যে বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম তার অনেকটা উত্তর আমি পেয়ে যাই।’ বলছিলেন আশীষ।
আশীষ তাঁর ভাবনার কথা বলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের সঙ্গে। এ জন্য অফিসেই বানানো হয় টিনের তৈরি ঘরের কাঠামো। তারপর পরীক্ষা চালানো হলো কতটা কার্যকর তা বোঝার জন্য। এই উদ্ভাবনীকাজে আগ্রহ নিয়ে যুক্ত হোন আশীষ পালের সহকর্মী ও গ্রের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ জাইয়ানুল হক। তারপর তাঁরা রাজধানীর নিকেতন হাউজিং সোসাইটির একটি বাসার ছাদেও উদ্ভাবনের নানা দিক নিয়ে কাজ করলেন। বেশ সাফল্য পেলেন তাঁরা। সে সাফল্যের সূত্র ধরেই তাঁরা ‘ইকো-কুলার’ প্রকল্পের পথে এগোলেন। ‘ইকো-কুলার’ প্রকল্পের বাকি গল্পটা শুনতেই আমরা হাজির হয়েছিলাম ঢাকায় এই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র উদ্ভাবন-প্রক্রিয়ার সূতিকাগার গ্রের কার্যালয়ে।
‘আমাদের দেশ বন্যাপ্রবণ, যে কারণে গ্রামের অধিকাংশ ঘর তৈরিতে মাটির বদলে টিন ব্যবহার করা হয়। গ্রামের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ এই টিনের ঘরেই বসবাস করেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই টিনের ঘরগুলো গ্রীষ্মকালে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির পুরুষ মানুষ ঘরের বাইরে গাছের তলায় বসতে পারে। কিন্তু নারীদের গরম সহ্য করে ঘরেই থাকতে হয়। এই বিষয়গুলো চিন্তা করেই আশীষ পালসহ আমরা দলগতভাবে সহজে কুলার তৈরি করার কাজ শুরু করি।’ তাদের দলীয় ভাবনার শুরুর কথা বলছিলেন মোহাম্মদ জাইয়ানুল হক।
গ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাউসুল আলম শাওন সঙ্গে যোগ করলেন, ‘আশীষের ভাবনাটা খুব চমকপ্রদ মনে হয়েছে আমার কাছে। কী সহজ একটি বিষয় অথচ কতটা বিজ্ঞাননির্ভর।’ কিন্তু গ্রে তো একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা মূলত? তারা কীভাবে যুক্ত হলো এ ধরনের উদ্ভাবনের সঙ্গে? তার ব্যাখ্যা শাওন দিলেন এভাবে।
‘নিয়মিত কাজের বাইরে প্রতিবছরই নতুন কোনো উদ্ভাবন নিয়ে মাঠে নামি আমরা। এই ইকো-কুলারকে উদ্ভাবন হিসেবে মানোন্নয়নের কাজ শুরু করা হয় গত বছরের শুরুর দিকে। এর কোনো প্যাটেন্ট আমরা করিনি। আমরা চেয়েছি সাধারণ মানুষ যাতে সহজে এটি বানিয়ে নিতে পারে।’
যেভাবে কাজ করে ইকো-কুলার
আপনি চাইলে ইকো-কুলারের শীতলীকরণ কাজটি নিজেই প্রমাণ করতে পারেন। কীভাবে করবেন? মুখের সামনে হাত মেলে ধরুন, তারপর মুখ হা করে জোরে শ্বাস ছাড়ুন। গরম বাতাসের অনুভূতি পাবেন হাতে। এবার একই কায়দায় মুখের সামনে হাত রাখুন, তবে হা না করে শ্বাস ছাড়ুন ঠোঁট সরু করে। এবার কিন্তু বাতাসের অনুভূতি পাবেন আগের চেয়ে ঠান্ডা। অর্থাৎ মুখ হা করে শ্বাস ছাড়ার পর বাতাসে যতটা গরম অনুভূত হয়েছে তার চেয়ে ঢের কম গরম বোধ হবে ঠোঁট সরু করে শ্বাস ছাড়লে। ঠিক এই সহজ বিষয়টিই ব্যবহার করা হয়েছে ইকো-কুলার তৈরিতে। এর ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় যদি তাপমাত্রা থাকে ৩০ ডিগ্রি। তাহলে ইকো-কুলারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঘরে যে বাতাস ঘরের ভেতরে ঢুকবে তার তাপমাত্রা নেমে আসতে পারে ২৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। উদ্ভাবক আশীষ পাল বলছিলেন, ‘বিদ্যুৎ–চালিত শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের মতো এটি দ্রুত বা সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমাবে না। তবে ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাও যদি আমরা কমাতে পারি গরমে অতিষ্ঠ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য সেটিও কম কথা নয়।’
আপনিও বানাতে পারেন ইকো-কুলার
১. প্রমাণ আকারের সরু মুখের প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করুন। ব্যবহৃত পরিশোধিত পানির বোতল, কোমল পানীয়ের বোতল এ জন্য সবচেয়ে ভালো। ২. ইকো-কুলার স্থাপনের জন্য ঘরের এমন জানালা নির্বাচন করুন যেখান দিয়ে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশ করে। এবার পুরো জানালার মাপ নিন। ৩. জানালার মাপ অনুয়ায়ী একটি বোর্ড সংগ্রহ করুন। এই বোর্ডেই বাসানো হবে বোতলগুলো। ৪. সংগ্রহ করা বোতলের ছিপি খুলুন। তারপর মুখের আকার অনুযায়ী মাপ নিয়ে বোর্ডে বৃত্তকারভাবে কাটুন। ছিপি ছাড়া বোতলের মুখ এই ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে। ৫. এবার ছিপির মাথা সমান করে কাটুন। ৬. বোতলের মাঝ বরাবর কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলুন। প্রতিটি বোতলের মুখ বোর্ডে ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করাতে হবে। তারপর মাথা কাটা ছিপি দিয়ে আটকে রাখুন বোতলটি। ব্যাস, তৈরি হয়ে গেল আপনার ইকো-কুলার। বোর্ডটি জানালায় স্থাপনের সময় বোতলের মুখ যেদিকে রয়েছে সে অংশ ভেতরের দিকে রাখুন।