মো. মাহমুদুল হাসান :: র্যাব নিয়ে চারদিকে অনেক কথা হচ্ছে। র্যাবের কর্মকাণ্ড আর ইতিহাসও সবাই কমবেশি জানেন। র্যাবের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-তর্কেরও শেষ নেই। কিন্তু খুব সাদামাটাভাবেই যদি পর্যবেক্ষণ করি তাহলেও দেখবো, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত কতবার তারা পথভ্রষ্ট, লক্ষ্যচ্যূত তার কোনো শেষ নেই। তারপরও কেন এ বাহিনীটিকে দুধ-কলা দিয়ে পোষা হচ্ছে? কার স্বার্থ এখানে বড়?
প্রথমদিকে দাগী কিছু সন্ত্রাসীকে ‘ক্রসফায়ার’ নামের মহানাটকের মাধ্যমে হত্যা করে বাংলাদেশি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের সমর্থন লাভ করে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীটি। জনগণ ভাবতে শুরু করে এবার দেশে সত্যিই শান্তি নেমে আসবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শান্তি নয়, নেমে আসে অশান্তি আর আতঙ্ক। কারণ তারা দেখতে পায় র্যাব টাকার লোভে মানুষ হত্যা শুরু করেছে। র্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে, র্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যক্তিগত শত্রু নিধনকল্পে। র্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকার অস্ত্র হিসেবে।
২০০৪ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠার পর ১৪ এপ্রিল কর্মকাণ্ড শুরু করে র্যাব। এই ১০ বছরে যে র্যাব সবই খারাপ কাজ করেছে তা নয়। কিন্তু বেশকিছু ঘটনা র্যাবের সব অর্জনকে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে, তাদের মুখে চুনকালি মাখিয়েছে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের আর ‘মুখ দেখানো’র জো নেই। এর আগে চট্টগ্রামে মাজারের ২ কোটি ৭ লাখ টাকা লুট, স্বর্ণ ব্যববসায়ী মৃদুলকে অপহরণের অভিযোগ রয়েছে র্যাবের বিরুদ্ধে। তারও আগে ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে র্যাবের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পা হারায় কলেজছাত্র লিমন। একাধিক সাংবাদিকও র্যাবের হাতে নির্যাতনের শিকার হন।
দেখা গেছে, প্রত্যেকটি সরকারই র্যাবকে তাদের রক্ষাকবজ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। কিন্তু কেন? সরকার কি এতোই ঠুনকো বিষয় যে একটি বাহিনীকে রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে হবে? বিএনপির আমলে সৃষ্ট হওয়া র্যাবকে ওই সরকারও ব্যবহার করেছিল। আর এখন আওয়ামী লীগ বলছে, র্যাব বিএনপির সৃষ্টি। এই দোষারোপের মধ্য দিয়েই একটি বিষয় স্পষ্ট হয়— বিএনপি খারাপ জিনিস বানিয়েছে— আমরা সেটিকে ভালো কাজে ব্যবহার করি কীভাবে?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম মেয়াদের শেষদিকে এসে র্যাবের বিরুদ্ধে গুম-খুনের বেশি অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে বিএনপির বেশকিছু নেতাকর্মী গুম হওয়ায় তা আরও প্রকাশ্য রূপ নেয়। এর ফলে ‘ভালো’ র্যাব এখন দেশ-বিদেশে একটি বিতর্কিত ‘কালো’ বাহিনী হিসেবেই পরিচিত। র্যাব সদস্যরা তাদের মূল কাজ থেকে সরে গিয়ে ‘ক্রসফায়ার’-এর নাটক বানাচ্ছেন। জড়িয়ে পড়ছেন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে। অপহরণ, খুন, গুম, জমি দখল, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির কাজে জড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের আস্থা হারিয়েছে ‘এলিট ফোর্স’খ্যাত এই বাহিনীটি। এমনকি টাকার বিনিময়ে ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করারও অভিযোগ উঠেছে র্যাবের বিরুদ্ধে।
একের পর এক অপহরণ, গুম আর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জে ৭ জনকে গুম ও নির্মমভাবে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনা উন্মোচিত হলে র্যাব নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে ২৭ এপ্রিল দিনদুপুরে তুলে নেয় র্যাব। এরপর ৩০ এপ্রিল তাদের লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যা নদীতে। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম ৪ মে অভিযোগ করেন, র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্প প্রধান লে. কমান্ডার এসএম মাসুদ রানা প্রতিপক্ষ কাউন্সিলর নূর হোসেনের কাছ থেকে ৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে ওই গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। র্যাবের এই তিন কর্মকর্তার সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে দিপু চৌধুরী। র্যাব-১১ অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মন্ত্রী মায়া’র জামাতা। গুমের পর শহিদুল ইসলাম মামলা করতে গেলে মামলাও নেওয়া হয় নি। তবে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পর জড়িত র্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। সেনাবাহিনী থেকে তাদের চাকরি গেছে। কিন্তু এর সুষ্ঠু বিচার শেষপর্যন্ত কি আদৌ হবে? হয়েছে কি এর আগে কখনো?
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, এ পর্যন্ত র্যাবের কোনো সদস্য ক্রসফায়ারে মারা যান নি, এমনকি গুলির আঘাতে আহত হয়ে তাদের হাত-পাও কেটে ফেলতে হয় নি। সাংবাদিকতার সূত্রে দেখছি, যত প্রেসরিলিজ আমাদের হাতে আসে তার সবটাতেই প্রায় একই ‘ফরম্যাট’। পরিবর্তন হয় শুধু স্থান, কাল আর পাত্র! “‘ক’ নামের সন্ত্রাসীকে আটকের পর অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সঙ্গীরা অজ্ঞাত স্থান থেকে অতর্কিতে হামলা চালায়, গুলিবর্ষণ শুরু করে। আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় ‘ক’ দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।” —এই হলো মোটামুটি একটা ফরম্যাট। র্যাব সদস্যের মধ্যে যারা এই নাটক মঞ্চস্থ করেন বা রচনা করেন তাদের ‘নাট্যজ্ঞান’ ও নাট্যরচনার মেধা ও ক্ষমতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু কেন এসব? কার স্বার্থে এসব? দেশে তো বিচারব্যবস্থা রয়েছে। দেশ-বিদেশের এনজিও, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), হিউম্যান রাইট্স ওয়াচসহ বিভিন্ন সংস্থার বারবার আপত্তি সত্ত্বেও কেন বন্ধ হচ্ছে না বিচারবহির্ভূত এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড?
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশে ২৬৮ জন গুম হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। গুমের পর ছেড়ে দেওয়া হয় ২৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের কোনো হদিস নেই। তারা বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন তাও কেউ জানে না। এসব গুমের অধিকাংশের সঙ্গেই র্যাব জড়িত বলে গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। তাহলে রাষ্ট্রের কি কোনোই দায়িত্ব নেই? দেশে কি সরকার নেই? র্যাব কি সরকারেরও উর্দ্ধে? র্যাব কি বিচারব্যবস্থাকে তোয়াক্কা করারও প্রয়োজন মনে করে না? র্যাব কি সর্বেসর্বা? এটা কি মগের মুল্লুক? র্যাব যা খুশি তা করে যাবে আর যে জনগণের টাকায় তাদের বেতন হয় সেই স্বাধীন দেশের লাখো-কোটি জনগণকে সব মুখ বুজে সইতে হবে?
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৪৬ জন গুম হন। এর মধ্যে ৩৩ জনের কোনো কোনো খোঁজ নেই। ওই তালিকায় আছেন ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম। ২০১০ সালের ২৫ জুন ঢাকার শেরেবাংলা নগর থেকে গুম হন ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম। চার বছর হলেও এখন পর্যন্ত তার খোঁজ নেই। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল গুম হন বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী। দু’বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু খোঁজ মেলে নি ইলিয়াস আলীর।
২০১১ সালে গুম হন ৫৯ জন। এর মধ্যে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়। গুমের পর ছাড়া পান ৪ জন। বাকি ৩৯ জনের কোনো খোঁজ নেই। ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আক্তার ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার পল্টন থেকে গুম হন। তিন বছর ধরেও তার কোনো খোঁজ নেই। স্ত্রী ঝর্ণা খানমের কান্নাই এখন সম্বল। ২০১২ সালে গুম হন ৫৬ জন। এর মধ্যে ৩৪ জনের খোঁজ নেই। একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি গুম হন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আল-মুকাদ্দাস এবং ওয়ালিউল্লাহ। হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও এখনো তাদের খোঁজ নেই। সরকার কি এসবের কোনোই দায় নেবে না? একটি স্বাধীন ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের সরকারের কাছে তাহলে জনগণ কি ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও পাবে না?
আসকের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর ৬৮ জনকে গুম করা হয়। এর মধ্যে ৫ জনের লাশ পাওয়া যায় এবং ৬ জন ছাড়া পায়। বাকি ৫৫ জনের কোনো খোঁজ মেলে নি। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে গুম হন লাকসাম বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম এবং পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ূন কবির। তাদেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।
আসক জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত মাত্র তিন মাসে ৩৯টি গুমের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আর অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীসহ ৪ জনকে। অন্য ২৩ জনের কোনো খোঁজ নেই। এরপর ২৭ এপ্রিল নারায়ণঞ্জে ৭ জনকে হত্যা ও লাশ গুম করে র্যাব। অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ারের নামে পরিকল্পিত হত্যার বিষয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘র্যাব’ পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাহলে এর দায় কি র্যাব এড়াতে পারে? আর র্যাব যদি তুলে গিয়ে না-ই থাকে তাহলেও সরকারি বাহিনী হিসেবে, সরকারের অংশ হিসেবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান দেওয়া তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অথবা তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, যে অভিযোগ উঠছে তা খণ্ডানোর দায়িত্ব তাদেরই। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি, তাতে তারা গা করছে না। অভিযোগের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ নিচ্ছে না র্যাব। তার মানে তারা এসব গুম, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড এসবের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট। একটি বাহিনীর বিরুদ্ধে এতো এতো অভিযোগ থাকার পরও তারা কেন নিশ্চুপ? এতে তো তাদের গায়ে চুনকালি পড়ছে। চোরের গায়ে মানুষ যেমনটা দেয়। একটি ‘রাজকীয় বাহিনী’র গায়ে এমন চুনকালির কথা ভাবতে সত্যিই খারাপ লাগে। কিন্তু এটি হচ্ছে বাস্তবতা! আমরা এর অবসান চাই। র্যাব থাকলে ভালোভাবে থাকুক। চুনকালি মুখে মেখে একটি বাহিনীর এমন নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড আমরা আর দেখতে চাই না।
লেখক: বার্তাবাংলা’র প্রধান সম্পাদক