বার্তাবাংলা ডেস্ক :: গুপ্তচর শব্দটিই ভীতিকর। এই বুঝি সবার অলক্ষ্যে ভয়ানক গোপন সংবাদটি গোপনে পাচার করে দিয়ে গোপনে চলে গেল গুপ্তচর। শোষণকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মূলত গুপ্তচরদের সৃষ্টি। প্রথমদিকে প্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজা-বাদশার শত্রুদের গোপনে হত্যার কাজ করতো তারা। পরবর্তী সময়ে নির্দিষ্ট রাষ্ট্র বা সংস্থার হয়ে গোপনীয়তা বজায় রেখে অন্যের গোপনীয়তা যারা নষ্ট করে দিতো গুপ্তচর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শীতল যুদ্ধের সময় গুপ্তচরদের দৌরাত্ম দেখা যায় দেশে দেশে। আগে গুপ্তচররা শুধু তথ্য পাচারের কাজ করতো। কিন্তু শীতল যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ইসরায়েল তার গুপ্তচরদের প্রথমবারের মতো ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের অলিম্পিককেন্দ্রিক এক হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে পরবর্তী কুড়ি বছর ধারাবাহিক অসংখ্য গুপ্তহত্যা যার স্বাক্ষ্য বহন করে।
বিশ্বের সকল গুপ্তচর সংস্থার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সংস্থার নাম মোসাদ। ইসরায়েলের এই গোয়েন্দা সংস্থা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের অনেক দেশে গুপ্তচরবৃত্তির কাজে কর্মীদের নিয়োজিত রাখে। সম্প্রতি মতি কাফির নামের এক লেখক ইতিহাসবিখ্যাত ইসরায়েলি গুপ্তচর সিলভিয়া রাফায়েলের ওপর একটি বই লিখেছেন। মোসাদ বাহিনীতে একজন নারী হিসেবে যোগদান, অতঃপর উত্থান ও মৃত্যু পর্যন্ত পুরো ঘটনাপ্রবাহ এই বইয়ে উল্লেখ করা আছে। সিলভিয়া রাফায়েলকে এখনও বিশ্বের গুপ্তচরদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বলে উল্লেখ করা হয়।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখ, বেলা সাড়ে চারটা। হালকা অস্ত্রে সজ্জিত আট জনের একটি বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এক গ্রামে। ইসরায়েলি কোয়ার্টার ভেঙে মিউনিখ অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করতে আসা তিন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদকে বের করে আনা হয়। দুইজনকে হত্যা করা হয়, একজনকে করা হয় জিম্মি। আক্রমণকারী বাহিনীর অপর দুই সদস্য আলী সালামেহ এবং আবু দাউদ বেড়ার বাইরে থেকে হামলার দৃশ্য দেখছিলেন। যখন তারা গুলির শব্দ শুনতে পান, তখনই বুঝতে পারেন যে অপারেশন সফল হয়েছে, এবার পালাতে হবে। নিকটবর্তী অপেক্ষারত গাড়িতে করে তারা কাছের বিমানবন্দরে চলে যান। সেখান থেকে তারা ভুয়া পাসপোর্টে সোজা চলে যান রোমে। রোম থেকে সালামেহ চলে যান বৈরুতে এবং আবু দাউদ চলে যান বেলগ্রেডে।
ওদিকে জার্মান নিরাপত্তারক্ষীরা গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছিল না, ঠিক কী ঘটছে সেখানে। তারা কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছিল না, কারণ তাতে যদি জিম্মি ইসরায়েলিদের কেউ আহত হন। এ অবস্থায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন তারা। মোসাদের প্রধান জাভি জামির দ্রুত মিউনিখে চলে আসেন এবং সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জার্মানির মধ্যস্থতা ইস্যুতে ভূমিকা পালন করতে চান। যুদ্ধে জামিরের অনেক অভিজ্ঞতা থাকলেও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মধ্যস্থতা করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। জামিরের এই প্রস্তাবে জার্মানী সোজা তাকে জানিয়ে দেয়, বাইরের কারো হস্তক্ষেপ তারা আশা করছে না।
মধ্যস্থতার এক পর্যায়ে জার্মান কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসী দলটিকে প্রস্তাব দেন, ইসরায়েলি জিম্মি ক্রীড়াবিদকে ছেড়ে দিতে হবে এবং বিনিময়ে তাদের একটি বিমানযোগে নির্বিঘ্নে উড়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। দলটি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা বিমানে ওঠার পর জিম্মীকে ছেড়ে দেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে জার্মান বাহিনী তাদের দিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। পুরে বিষয়টিই ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ। জার্মান বাহিনীর গুলিতে দলটির পাঁচজন মারা যায়, একজনকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়।
সালামেহ ততক্ষণে বৈরুতে অবস্থিত ফিলিস্তিনি গুপ্তচর সংস্থা ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদরদপ্তরে পৌছে গেছেন। সেখানে পৌঁছে জানতে পারেন জার্মান বাহিনী কিভাবে তার দলের অন্য সদস্যদের হত্যা করেছে। সেদিন রাতেই ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের হত্যা করার আনন্দ উদযাপন করছিল ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির। বলা হয়ে থাকে, সেসময় ইয়াসির আরাফাত হাসতে হাসতে আলী সালামেহকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলে, তুমি আমার ছেলে…।’ আলী সালামেহ তার অফিসে চলে আসেন এবং নতুন নতুন হামলার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
পুরো বিষয়টি প্যারিসের একটি ফ্ল্যাটে বসে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করছিলেন কেউ। তিনি হলেন ইসরায়েলি গুপ্তচর সিলভিয়া রাফায়েল। টেলিভিশনের পর্দায় মুখোশধারী সন্ত্রাসী ও জার্মান বাহিনীর নৃশংসতা দেখছিলেন তিনি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে কিংবা বাইরে কোনো নাগরিকের ওপর হামলাকে সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। এর আগে আরও অনেক হামলার পরিকল্পনা মোসাদ নষ্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু অলিম্পিকের মতো একটি অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদদের ওপর হামলা হবে এটা মোসাদ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। হামলার পরের দিন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হেরাল্ড ট্রিবিউনের শিরোনামে ছাপা হয়, আলী সালামেহর নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটিয়েছে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর। প্যারিসে নিজের পরিচয় সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে অন্যান্য কোনো মোসাদ এজেন্টের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না সিলভিয়ার। শুধু তার উর্ধ্বতন এজেন্ট ডেভিডের সঙ্গে তার অল্প যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পর ডেভিডও ইসরায়েল চলে যায়। তারপরও সিলভিয়া ডেভিডকে ফোন করে দেখা করতে চান। দু’জনের দেখা হলে সিলভিয়া ডেভিডকে হেরাল্ড ট্রিব্রিউনের নিবন্ধটি দেখান এবং বলেন, ‘আমার মনে হয়, সালামেহই এখন আমাদের মূল টার্গেট।’ প্রতিউত্তরে ডেভিড বলেন, ‘আমারও তাই মনে হয়।’ সিলভিয়া ডেভিডের মাধ্যমে মোসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বলে পাঠান, এর বিপরীতে যেন ইসরায়েলি গুপ্তচরদের একটি দল প্রেরণ করা হয়।
ডেভিড মোসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কোনো ইতিবাচক সাড়া পান না। কারণ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের কোন কোন সদস্যের ওপর আঘাত হানা হবে সেবিষয়ে স্পষ্ট কোন তথ্য তখনও মোসাদের কাছে ছিল না। আর এই ফাঁকা জায়গাতেই মঞ্চে প্রবেশ করেন সিলভিয়া। তার কাছে থাকা তথ্যদি তিনি তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে সরবরাহ করেন। এরপর গোল্ডা মেয়ারের তত্ত্বাবধানে মোসাদের একটি বিশেষ বাহিনীকে ‘ঈশ্বরের ক্রোধ’ নামের একটি অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর এই পুরো অপারেশনটির নকশা করেন সিলভিয়া। আর মোসাদের ওই গোপন দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেন মাইক হারিরি। মোট পাঁচটি স্কোয়াডে ভাগ করা হয় দলটিকে। প্রতি স্কোয়াডে ছির ১৫ জন সদস্য।
অপারেশনের অংশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর মোসাদ বাহিনী রোমে ফিলিস্তিনের একজন অনুবাদক ও পিএলও’র প্রতিনিধি আতিয়ারকে হত্যা করে। আতিয়ার যখন রাতের খাবার শেষ করে বাসায় ফিরছিল তখন তার ওপর অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। গুণে গুণে বারোটি গুলি করা হয় তাকে। এরপর একই বছরের ৮ ডিসেম্বর ফ্রান্সে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সদস্য মাহমুদ হামশারিকে টোলিফোন বোমায় হত্যা করে মোসাদ। অপারেশনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ফাতাহ’র প্রতিনিধি হুসেইন আর বশিরকে হত্যা করা হয় সাইপ্রাসে। একই বছরের ৬ এপ্রিল বৈরতে বাসিল আল কুবাসিকেও আতিয়ারের মতো ১২বার গুলি করে হত্যা করা হয়। টানা বিশ বছর এই অভিযান চালিয়ে যায় ইসরায়েল।
অপারেশন চলাকালীন সময় ‘রেড প্রিন্স’ নামে খ্যাত আলী সালামেহকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা চালান সিলভিয়া। কিন্তু ভুল তথ্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে সালামেহ ভেবে আহমেদ বুশিকি নামের এক মরক্কোর নাগরিককে হত্যা করেন সিলভিয়া। অভিযোগ প্রমাণিত হলে নরওয়ে আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন, যদিও ১১ মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর তিনি মুক্ত হয়ে যান। যে আইনজীবি তাকে কারাগার থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করেছিল সেই আইনজীবিকেই বিয়ে করে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়।
এতো গেলো কেবল একটি ঘটনার খণ্ডাংশ। মোসাদের পক্ষে পরিচালিত এমন আরও অসংখ্য অপারেশনের পরিকল্পনা করেছেন এই গুপ্তচর নারী। ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে মারা যান।