বার্তাবাংলা রিপোর্ট :: শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ উপন্যাসে অচলা স্বামী হিসেবে মহিমকে পেয়েও পরপুরুষে আসক্ত হয়েছে। অচলা উচ্চশিক্ষিতা, আধুনিক। মহিমও উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক এবং অবস্থাপন্ন। বাহ্যিক বিচারে তারা দুজনই পরস্পরের উপযুক্ত। তারপরও সুরেশের অপ্রতিরোধ্য আবেদনের কাছে হার মেনেছে অচলা। মহিমের অটল গাম্ভীর্য ব্যক্তিত্ব এবং সুরেশের প্রতিরোধহীন আবেদনের মধ্যে পড়ে অচলা দিশেহারা। সুরেশের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য অচলার দোলাচল যে বহুলাংশে দায়ী, তা স্পষ্ট হয় মৃণালের সঙ্গে তুলনা করলে। মৃণাল গ্রামের একটি সাধারণ মেয়ে। তার ভেতরে অতৃপ্তি নেই, বয়স্ক স্বীমার কারণে নেই আক্ষেপ। স্বামীর সঙ্গে বয়সের বিস্তর পার্থক্যকে তাচ্ছিল্য করে স্বামী, সংসার নিয়ে দিব্যি সুখী গৃহিণী। আধুনিক নর-নারীর দাম্পত্য জীবনের বহুমাত্রিক সংকট, আধুনিক মানুষের অন্তর্গত জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা, দাম্পত্য বিষয়ে পুরুষের আত্মজিজ্ঞাসা, নারী ও পুরুষের অতৃপ্তিবোধ তাকে তাড়া করে অন্য কারো মাঝে স্বস্তি বা শান্তি খুঁজে পেতে। অচলা তেমনই একজন। অচলা বা সুরেশ আধুনিক সমাজের প্রতীকী চরিত্র মাত্র। মানুষ যখন সবেমাত্র গোষ্ঠীজীবনে প্রবেশ করছে, নারী তখন কারো একক সম্পত্তি নয়। বরং নারীর অধীনেই সমাজ। বহুগামিতা তখন নিন্দনীয় নয়। পরকীয়া বলে তখন কিছু নেই। কারণ সব নারী এবং সব পুরুষই সকলের। অবাধ সম্পর্কের কাল তখন। এই রীতির অবশেষ চলেছিল আরো বহুদিন। নৃতাত্ত্বিক সারা ব্ল্যাফার হার্ডি মনে করেন, মানুষ যখন বনে বনে থাকত, মূলত গাছগাছালিই ছিল বসতি, তখন নারীরাও ছিল বহুগামী। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে নারীরাও বহু পুরুষের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ তৈরি করত। সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করতে চাইত বেঁচে থাকার এবং নিজ সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনেই। অরণ্য পর্বের পরে আজ থেকে হাজার বছর আগে মানুষ তৃণভূমিতে নেমে আসে। এরপর যুগলবন্ধনের মাধ্যমে দাম্পত্য জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন থেকেই নারীর যৌনতাকে অবদমিত করা হয়। ব্যাপারটা আরো ত্বরান্বিত হয় মানুষ যখন প্রবেশ করে কৃষিপর্বে। তখন সম্পদশালী হয়ে ওঠে বিভিন্ন গোত্র। একসময় ওই সম্পদ অধিকারে চলে আসে গোত্রপতিদের। তারা হয়ে ওঠে সম্পদশালী, উদ্ভাবন ঘটে ব্যক্তিগত মালিকানার। সম্পদ যত বাড়তে থাকে পরিবারে নারীদের থেকে গুরুত্ব বাড়তে থাকে পুরুষদের। পুরুষ সৃষ্টি করে পিতৃতন্ত্রের প্রথা। নারী পরিণত হয় পুরুষের সম্পত্তিতে। পিতৃতন্ত্রের মূল লক্ষ্য থাকে যেহেতু সন্তানের ‘সুনিশ্চিত পিতৃত্ব’, সে জন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজে জৈবিক এবং সামাজিক কারণেই বহুগামী স্ত্রীকে ‘হুমকি’ হিসেবে দেখা হয়। স্ত্রী বহুগামী হলে তার প্রভাব পড়ে ভূস্বামীর সম্পত্তিতে, সামাজিক পদপর্যাদায়। সনাতন কৃষিভিত্তিক সমাজে নারীকে যাচাই করা হয় দুটি বৈশিষ্ট্যের নিরিখে– নারী তার পিতৃকুল থেকে যৌতুক, উপঢৌকন নিয়ে এসে স্বামীর সম্পত্তিকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পারবে এবং শারীরিক সৌন্দর্য আর গর্ভে সন্তান ধারণে কতটা উপযুক্ত। তাই দেখা যায় বহু কৃষিভিত্তিক সমাজে পুরুষের বহুগামিতার ব্যাপারে আইনকানুন শিথিল হলেও নারী বহুগামিতাকে সব সময়ই অধিকতর নিন্দনীয়ভাবে দেখা হয়; বহুগামী স্ত্রীকে শারীরিক নিগ্রহ, এমনকি হত্যা করা হলেও খারাপ চোখে দেখা হয় না।
প্রাচীন টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস অববাহিকায় গড়ে ওঠা কৃষিভিত্তিক সভ্যতা থেকে জানা যায়, সেখানে সাধারণভাবে মনে করা হত নারীরা স্বামীর ‘অনুগামী’ থাকবে। তারা চিরকাল স্বামীর সঙ্গে একগামী সম্পর্কে আস্থাশীল থাকবে। পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি ছিল না। পুরুষ ছিল বহুগামী। আর পুরুষের বহুগামিতাকে ততটা খারাপ চোখে দেখা হতো না। যে সমস্ত স্ত্রীরা পরকীয়ায় মত্ত হতো, তাদের নাক কেটে ফেলা হতো। চীন, জাপান ও ভারতের অনেক স্থানে এখনো পুরুষের রক্ষিতা রাখা কিংবা গণিকা সম্ভোগকে ‘এডাল্ট্রি’ হিসেবে গণ্য করা হয় না। যুগপরিক্রমায় মানুষ যখন সভ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে, তখন কামনার সঙ্গে সমৃদ্ধ হতে থাকে ভালোবাসা নামক বোধটি। নারী-পুরুষ চিন্তার স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধে ঋদ্ধ হতে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের অন্তর্গত জটিলতাও। ব্যস্ত মানুষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ ও অতৃপ্ত। একঘেঁয়েমি কাটাতে স্বস্তি খোঁজে নতুন কারো কাছে। পুরুষের মাঝে প্রকৃতিগতভাবেই বহুগামী স্বভাব প্রবল। বিবাহিত জীবনে স্বস্তি না মিললে কিংবা সঙ্গীর সঙ্গে মানসিকতার মিল না হলে সমাধান খোঁজে পরকীয়ায় মধ্যে। এখন কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী-পুরুষের সহজে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে। এতে তারা একে অন্যের সঙ্গে মানসিকভাবে কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। ক্রমে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ সম্পর্ক তার জীবনে ক্ষণিকের জন্য রোমাঞ্চকর হয় বটে, পরিণতে জীবনের নতুন করে জটিলতা তৈরি করে, ব্যক্তি এবং পারিবারিক জীবনে সৃষ্টি করে অস্থিরতা। দৈনন্দিন ঘরকন্নায়, পরিবারের সবার দাবি মেটাতে গিয়ে নারী নিজেকে হারিয়ে ফেলে। একসময় সে খুঁজে ফেরে নিজেকে, যা সে হারিয়ে ফেলেছে স্ত্রী-মা-মেয়ে-বউমা-মামি-চাচি বিভিন্ন নামের ভিড়ে। প্রতিনিয়ত এভাবে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় সৃষ্টি হয় আত্মজিজ্ঞাসার। যা থেকে মুক্তি পেতে অন্যকে আশ্রয় করে বা অন্যকে আঘাত করার প্রবণতা দেখা দেয়। সাধারণের দৃষ্টিতে সে এক উদ্ভ্রান্ত নারী, তার ভেতরের যে অবস্থা তা অনেকে ভুল ব্যাখ্যা করে। এই ভুল ব্যাখ্যার সূত্রে নারী সামাজিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। সমাজ বা পরিবার নারীকে বেঁধে দেয়- সে কী করবে বা কীভাবে চিন্তা করবে। তারা চাই তার চিন্তা শুধু স্বামী-সংসার পরিবার-পরিজন নিয়েই পাক খাবে। তার আত্মপরিচয় গড়ে ওঠা যে জরুরি সে কথাটি সমাজ মনে করে না। বিয়ে, স্বামী এবং সংসার মুখ্য হয়ে ওঠে একটি মেয়ের পরিচয় হিসেবে। এখনো আমাদের পারিবারিক ব্যবস্থায় ভালো নারী তারাই, যারা স্বামী-সংসার ভিন্ন অন্য চিন্তা করে না। কিন্তু একজন নারীর সত্তার সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা, দায়িত্ববোধ, মাতৃত্ববোধ যেমন জড়িয়ে আছে, তেমনি আছে পরিশীলিত মন, সৃজনশীল প্রতিভা এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছা। একজন নারী যখন অস্তিত্ব সংকটে ভোগে, তখন সে আত্মপরিচয়ের খোঁজে হাতড়ে বেড়াতে থাকে, তখন মানসিক শূন্যতাবোধ তার মধ্যে কাজ করে। তখন কোনো ব্যক্তি তার সামনে আমিত্বকে তুলে ধরে, অনেক সময় ওই নারী তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ওই পুরুষের মধ্যে সে নিজেকে খুঁজে পেতে চায়। নতুন করে জীবনকে ভালোবেসে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পায়। তবে নারীকে বুঝতে হবে এই প্রেমটা অলীক, এটাও হারিয়ে যাবে। নারীর আত্মপরিচয়ের জায়গা তার নিজের তৈরি করতে হবে। একজন নারী তার নারীত্ব বিসর্জন দিয়ে পরিপূর্ণ নারী হতে পারে না। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কামনার দিক থেকে সব নারী-পুরুষই বহুগামী, শুধু সুযোগের অপেক্ষা বা সুযোগ তৈরি করে নেওয়ার সাহসের অভাব। অন্য কাউকে মুহূর্তের জন্য কামনা করেননি এমন ব্যক্তি সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বহুগামী মন স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে অন্যের সঙ্গ খুঁজবে। নিজের সঙ্গীর কাছে যাতে অতৃপ্তি, অন্যের কাছে তা খোঁজার জন্য মন উঁকি-জুঁকি করে। বন্ধুত্ব, আদান-প্রদান, সময় কাটানো, উপহার, শ্রদ্ধাবোধ, এমনকি নির্ভরতা- এগুলো স্থায়িত্বকাল বেশি না হলেও এসবে প্রাপ্তি নিশ্চিত ঘটে। একঘেঁয়ে জীবনের কাছে এসবের আবেদন অনেক। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সহাবস্থান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মেলবন্ধনে নারী-পুরুষ কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে, এতে অতৃপ্ত নারী-পুরুষের পরকীয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নারীর কাছে সংসার মন্দিরের মতো। সে সংসারের অন্যতম সদস্য। সংসারকে সুখী করতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। তারপরও সেই সংসার এবং প্রিয় মানুষটির প্রতি কেন আস্থা রাখতে পারে না? কেন জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়? তার একক কোনো উত্তরও নেই। তবে পরিবারের মধ্যে সহমর্মিতা, সবার মত প্রকাশের সুযোগ এবং মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, পরিশীলিত চিন্তা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ, স্বাভাবিক যৌনজীবন, সুস্থ বিনোদন ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা থাকলে পরকীয়া বহুলাংশে রোধ করা সম্ভব। পরকীয়া মূল সমস্যার একটি প্রকাশ মাত্র। পরকীয়া মানব মন ও আচরণের জটিল সমীকরণ মেনে এগোয়। গৃহদাহ-এর অচলা উদ্ভ্রান্ত। সে জানে না সে কি চাই? কার কাছে সে সুখী হবে- মহিম বা সুরেশের কাছে? পরকীয়ায় অচলার তৃপ্তি বা নির্ভরতা কোনোটাই মেলেনি। বরং দিয়েছে অনিশ্চয়তা। পরণতি শুভ হয়নি সুরেশেরও।
মন্তব্য যুক্ত করুন