লন্ডন থেকে রবিবার রাতে যাত্রা শুরু করে সোমবার সন্ধ্যায় চীনের গুয়াংজুতে পৌঁছাই। সারারাত আর সারাদিন বিমানে ভ্রমণের পরও ঘড়ির কাঁটায় সময় কেবল ১১ ঘণ্টা! মাঝখানের বড় একটা সময় জীবনের পাতা থেকে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
গুয়াংজু থেকে ব্রিসবেনের পথে আরও একবার সময় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। ভ্রমণ কখনো কখনো এমন এক ধাঁধা, যেখানে সময় আর স্থান একে অপরকে মুছে দেয়।
গতকাল, মঙ্গলবার সকালে দেশে ফিরলাম ২৮ দিনের দীর্ঘ এক ছুটি শেষে। ফিরে এসে পরিবারের সবাইকে ভালো দেখে মনটা শান্ত হয়েছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের সামলানো, তাদের দুষ্টুমি সহ্য করা— এইসবের জন্য আমার সহধর্মিণী লুনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া, আমরা সবাই নিরাপদে দেশে ফিরতে পেরেছি।
এই চার সপ্তাহের সফরে আমরা পা রেখেছি ৮টি দেশ, ২১টি শহর এবং আনুমানিক ২০টিরও বেশি গ্রামে। যাদের অধিকাংশই ছিল সুইজারল্যান্ডের মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি গ্রাম, স্কটল্যান্ড-ব্রিটেনের হাইওয়ের ধারে অবস্থিত ছিমছাম জনপদ, এবং জার্মানির কিছু ঐতিহ্যবাহী গ্রাম।

সুইজারল্যান্ড থেকে ইতালির দিকে যাত্রার পথে রাস্তার পাশে অবস্থিত বেশ কিছু অপরিচিত অথচ মন কাড়া গ্রামেও যাওয়া হয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এসব গ্রামের শান্ত পরিবেশ হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। অনেক জায়গা ছেড়ে আসতে মন খারাপ লাগছিল।
এই সম্পূর্ণ ভ্রমণ ছিল আমাদের নিজেদের (পড়ুন, ভাড়া করা) গাড়িতে। যার ফলে ইচ্ছেমতো থামা, ছোট ছোট ট্যুরিস্ট স্পটে যাওয়া কিংবা রাস্তার ধারে কোনও গ্রামে ঢুঁ মেরে আসা— সবই সম্ভব হয়েছে। এই স্বাধীনতা ভ্রমণের অন্যতম সৌন্দর্য।
বড় বড় শহরের দামী দর্শনীয় স্থান ছাড়াও আমরা আবিষ্কার করেছি অজানা, অনামি কিছু জায়গা, যাদের সৌন্দর্য কোন অংশেই কম নয়। স্থানীয়দের সঙ্গে হালকা কথাবার্তা, ছবি তোলা, কিংবা পথেঘাটে মেয়েদের সঙ্গে স্মৃতির ক্যামেরায় মুহূর্ত ধারণ— সব মিলিয়ে একটা পারিবারিক অ্যাডভেঞ্চারের রূপ পেয়েছে এই ভ্রমণ।
স্কটল্যান্ড থেকে ফিরে লন্ডনে অবস্থান করার পর আমরা ইউরোস্টার ট্রেনে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে প্যারিস যাই। সেখান থেকেই আমাদের আসল ড্রাইভিং যাত্রা শুরু হয়।
৯ জনের এই দল নিয়ে প্যারিস থেকে গাড়ি ভাড়া করে আমরা রওনা দেই সুইজারল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এবং আবার প্যারিস হয়ে লন্ডনে ফেরার জন্য।

পুরো ভ্রমণে আমরা প্রায় ৮,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছি— শহরের ব্যস্ত রাস্তা, গ্রামের শান্ত পথ, হাইওয়ের দিগন্তবিস্তৃত লাইন আর আল্পস পর্বতের গা ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে।
এই দীর্ঘ যাত্রায় আমরা অতিক্রম করেছি ১২০-১৩০টি টানেল, যার মধ্যে কিছু ছিল ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ! পথ চলায় পায়ে হেঁটে পেরিয়েছি ৩০-৩৫ কিমি, শুধু ইতালির ফ্লোরেন্স শহরেই আমাদের স্টেপ কাউন্ট ছিল ২৭,৬০০!
আমার দুই বছরের মেয়েটিও আইফেল টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় উঠতে গিয়ে ৬৬৮ সিঁড়ির মধ্যে ৪০০টির মতো নিজেই উঠেছে—এই ছোট্ট বাচ্চাটির জন্য সেটাও এক বিশাল অর্জন!
লন্ডনে শেষ তিনদিন ছিল একপ্রকার ছুটির পূর্ণতা। সেন্ট্রাল লন্ডনের বিখ্যাত স্পটগুলোতে ঘুরে বেড়ানো হলেও শহরের প্রতি খুব একটা টান অনুভব করিনি। রাজার বাড়ির বাহ্যিক চেহারা দেখে একটু হতাশই হয়েছি— চুনকাম জরুরি!
ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখে মিশ্র অনুভূতি হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যের সংগ্রহশালা হলেও ব্রিটেনের নিজের কিছুই নেই! অনেকটা যেন “চুরি করা ঐতিহ্যের গুদাম”! জিনিসগুলো বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে দখল করে এনে সাজিয়ে রেখে লেখা—”Collected by…”, পড়ুন “চোর অমুক”। ইতিহাসের এসব কাণ্ড দেখে একটু কৌতুকবোধও জেগেছে।
পুরো ভ্রমণটিতে বিভিন্ন দেশে থাকা আত্মীয়, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতা ছিল অবিস্মরণীয়। বিশেষ করে নূরজাহান রউফ ও প্রতীক আব্দুর রউফ— তাদের বাড়িতে আমরা ৫-৬ দিন কাটিয়েছি। অসাধারণ আতিথেয়তা আর ভ্রমণে সহযোগিতার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

তিন দিনের ছুটি নিয়ে একটানা আমাদের সাথে সময় কাটানোর জন্য ধন্যবাদ বাবলু ভাই ও তার পরিবারকে। মনজু ভাই, একা, মনি ভাই-চুমকি ভাবি, আরাফাত, সজীব ভাই ও তার পরিবার, মঈনুল ভাই-নিলকোনা ভাবি, মিলার ইলোনা, বায়েস ভাই— আপনাদের সবার আন্তরিকতা এই ভ্রমণকে অনেক বেশি অর্থবহ করে তুলেছে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছোট ভাই বায়েস ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লেগেছে, বিশেষ করে যেদিন তিনি আমাদের সুন্দর একটি ডিনারে আপ্যায়ন করেন।
সবচেয়ে বড় ধন্যবাদ যায় আমার শালাবাবু আহমেদ জিসানকে, যিনি ভ্রমণের পুরোটা সময় আমাদের জন্য ছিলেন নিরলস সহায়ক।
এই পুরো সফরে জীবনে প্রথমবারের মতো কিছু জায়গা চোখের সামনে দেখেছি, যেগুলো এতদিন শুধু বইয়ে, টিভিতে কিংবা ইউটিউবে দেখেছি। জীবনের এই অভিজ্ঞতার জন্য আমি আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞ। তিনি আমাদের সময়, স্বাস্থ্য ও সামর্থ্য দিয়েছেন এই অভাবনীয় সফরের জন্য।
ভ্রমণের ক্লান্তি সত্ত্বেও পেটের দায়ে কাজ শুরু করতেই হবে। তবে এই সফর আমাদের মনে চিরকালীন স্মৃতি হয়ে থাকবে।

পরিবার নিয়ে এমন একটি ভিন্নধর্মী অ্যাডভেঞ্চার যে কতটা আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয় হতে পারে, তা আমরা এবার চোখে দেখেছি। আমাদের মেয়েদের জন্যও এটি একটি অসাধারণ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা।
সবার কাছে অনুরোধ, আমাদের পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। নতুন সফরের জন্য মন প্রস্তুত হলেও পাসপোর্ট এখন কিছুদিন বিশ্রামে থাকুক!
ভ্রমণের গল্প এখানেই শেষ নয়, প্রতিটি শহর, গ্রাম, পাহাড়, নদী— সবই আলাদা করে বলার মতো। সময় পেলে আবার লিখবো ইউরোপের বিভিন্ন শহরের আলাদা ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে।