সিরাজগঞ্চে মেসো-লেভেল বন্যা বীমা!
জাহিদ আল আমীন :: মাত্র আট হাজার টাকায় পুরো মাসে পাঁচ সদস্যের একটি নি:স্ব পরিবারে কী হতে পারে? উত্তরটা জানার আগে সরেজমিনে ঘুরে আসি সিরাজগঞ্জে শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দুরের গ্রাম আখনাদীঘি চর। যমুনার বুকে চারদিক পানি বেষ্টিত একখন্ড জমি। মোছাম্মোদ আসমা বিবি সেই চরের বাসিন্দা। স্বামী-সন্তান নিয়ে পাঁচ জনের সংসার। বসতবাড়ি ছাড়াও আসমার তিন বিঘা চাষের জমি ছিল। জমির ফসল আর স্বামীর আয় দিয়ে স্বাচ্ছন্দেই দিন যেত। কিন্তু কাল্ হলো সর্বনাশা বন্যা। বন্যায় ভেসে গেল জমির ফসল, গবাদি পশু, সবকিছু। নিজেদের সামান্য আশ্রয় বসত-বাড়িটিকেও ছাড় দেয়নি সর্বনাশা বান। তাই এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে মাথায় হাত। আর চোখের কোণায় নোনা জল। কাল কী খাবে সেটাও অজানা আসমার।
শুধু আসমাই নয়, সিরাজগঞ্জে ২০০৭ সালের ভয়াবহ বন্যার পরে সর্বশান্ত হয়েছিল শেফালী, মোজাম্মেল, আলতাফ, শাহিদাসহ অর্ধলক্ষাধিক পরিবার। এক সময়ের স্বচ্ছল, সুখি পরিবারগুলো আজ অনাহারে, অর্ধাহারে। একেকটি বন্যার পরেই একই চিত্র ভেসে ওঠে সিরাজগঞ্জে চরগুলিতে। মাথা গোঁজার জায়গার ব্যবস্থা আর বেঁচে থাকার তাগিদে স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে মহাজনদের কাছে। চড়া সুদের ঋণ নিয়ে সেই ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করতেই নিতে হচ্ছে বিকল্প ঋণ। এ ভাবেই চলছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কাটিয়ে উঠতে পারছে না ঋণের বোঝা। অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতে বিক্রি করছেন নিজের অবশিষ্ট সম্পত্তিটুকু।
বন্যাকবলিত এ সকল এলাকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ সবকিছু ছেড়ে শহরের বস্তিগুলিতে ঠাঁই নিয়েছে। আশংকাজনকহারে বাড়ছে জলবায়ু শরনার্থীর সংখ্যা। স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা, এমএমএস এর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৮ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে শুধুমাত্র সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চল থেকে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার অন্তত ২৫হাজার মানুষ স্বভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
গত ৫০ বছরের বন্যা পরিস্থিতির তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষরণ দেখা গেছে, পৃথিবীর ৬০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেটি বছরে দুই বা ততোধিক সময় দূর্যোগের মুখোমুখি হয়। এসব বন্যায় দেশের প্রায় ২১ ভাগ জমি প্রতি বছর প্লাবিত হয় এবং ১৯৫৪ হতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ১৬ টি বড় ধরনের বন্যা বিপর্যয় ঘটেছে, গড়ে প্রায় প্রতি ৩.৩ বছর পর-পর এ ধরনের বিপর্যয় হয়েছে।
ইউএনডিপির ২০০৪ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারনে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার সর্বাধিক, ১৯৭০ হতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ১৭১টি দূর্যোগ দূর্ঘটনায় পুরুষ, মহিলা এবং শিশুসহ মোট মৃত্যুর সংখ্য ৫১৬,২৩৯ জন।
এমনই এক পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত মানুষের ক্ষতি কাটিয়ে দীর্ঘস্থায়ী অবসান ঘটাতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম উদ্ধাবনীমূলক মেসো-লেভেল বন্যা বীমা প্রকল্পের প্রবর্তন করেছে। উদ্ভাবনীমূলক এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাস্তব সম্মত কৌশল অবলম্বন করে নদী অববাহিকায় বসবাসরত জলবায়ূ পরিবর্তন এবং দূর্যোগে বিপদাপন্ন দরিদ্র ও অতি দরিদ্র নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী এবং বয়ষ্ক মানুষের বন্যা ঝুঁকি স্থানান্তর ও সক্ষমতার উন্নয়ন করা এবং সম্পদ রক্ষা করা।
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক সম্পৃক্ততার পাশাপাশি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুইস এজন্সী ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন (এসডিসি), ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাব্লিউএম), মানব মুক্তি সংস্থা (এএমএমএস), আন্তর্জাতিক বীমা প্রতিষ্ঠান সুইস রি এবং প্রগতি ইনসুরেন্সের সহযোগিতায় ভূক্তভুগীদের জন্য বন্যা বীমার প্রকল্প চালু করেছে।
২০১২ সালের জুন মাস থেকে সিরাজগঞ্জের সদর ও চৌহালি উপজেলার ১০টি গ্রামে (ফুলবাড়ি, পঞ্চসোনা, খাশবড় শিমূল, চক বয়রা, মল্লিক পাড়া, আখনাদিঘী, বড় চৌহালী, ছোট চৌহালী, ফুলহারা, মুরাদপুর) শুরু হওয়া এই কর্মসূচীতে এ পর্যন্ত ১৬৬১টি পরিবারকে এ প্রকল্পের অধীনে নিয়ে এসেছে সংস্থাটি। নির্ধারিত মাত্রা ও সময় (১০.৯০ মিটার থেকে ১৪.৩৫ মিটার) পর্যন্ত বন্যার পানি ১১ থেকে ২৬ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকলে বীমার অর্থ ভূক্তভুগীদের পরিশোধ করা হবে। এই ধারণা অনুয়ায়ী বীমার জন্য কৃষকদেরকে নিজের পকেট থেকে কোন অর্থ ব্যয় করতে হবেনা। প্রিমিয়ামের পুরো টাকাটা আসবে সরকার অথবা দাতা সংস্থাগুলোর নিকট থেকে।
এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাব্লিউএম) এর গবেষক ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বন্যার ক্ষতির পরিমান নির্ধারন করা যেমন জটিল কাজ তেমনি স্থান বিশেষে পানির উচ্চতা ও ক্ষতির পরিমানের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সিরাজগঞ্জের শহর রক্ষা বাধ তথা হার্ট পয়েন্টে সরকার নির্ধারিত বন্যার বিপদ সীমা ১৩.৩৫ মিটার হলেও দুর্গম চর এলাকায় বিপদসীমা নির্ধারণ করা হয়নি। প্রকল্প এলাকায় পানির উচ্চতা তথা বিপদসীমা নির্ধারণসহ উদ্ভাবনী বন্যা বীমা প্রকল্প নিয়ে আরও বেশি গবেষণার অবকাশ রয়েছে।
এই বন্যা বীমার প্রকল্পের সদস্য আখনাদীঘির শাহানা খাতুন জানান, গেল বন্যায় আমার চাষের জমিসহ থাকার জায়গাও বানের ¯্রােতে ভেসে গেছে। তারা কিছু টাকা দিয়ে ছিল, সেগুলো দিয়ে কয়েকদিন খাবার জুটেছিল। বন্যার পরে কয়েকদিন বাচ্চাদের মুখে দু’বেলা ভাতও দিতে পারিনি। তবে এবার বন্যা এলে আমার আর চিন্তা নাই। বীমার আট হাজার টাকা পাবো। আমার আর ত্রাণের জন্য কারো কাছে হাত পাততে হবেনা, না খেয়েও থাকতে হবে না।
বন্যা বীমা প্রকল্পের স্থানীয় পর্যায়ের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান মানব মুক্তি সংস্থার পরিচালক হাবিবুল্লাহ বলেন, আমরাইসরাজগঞ্জে ক্ষুদ্র পরিসরে মেসো-লেভেল বন্যা বীমা ধারণাটি নিয়ে কাজ শুরু করেছি। এই ধারণাটিকে ক্ষেত্রে অনেক কাজের সম্ভাবনা আছে। প্রতিটি বন্যার পরে যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়, তার পরিমান বিপূল। কমিউনিটি বেইস্ড অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে এই বীমা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ প্রতিটি পরিবার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার একটি দারুন সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো বন্যার পরে যে বিপূল পরিমান অর্থের ত্রাণ বিতরণ করে, তার এক পঞ্চমাংশ ব্যয় করেই বন্যাদুর্গতদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে অক্সফামের ইকোনোমিক অ্যান্ড প্রাইভেট সেক্টও কো-অর্ডিনেটর নুরুল আমীন বলেন, প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের বন্যা কবলিত মানুষের বন্যা ঝুঁকি বীমা বাজারে স্থানান্তরের একটি চমৎকার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে এই প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এ ধরনের উদ্দ্যোগ গ্রহনের মাধ্যমে সরকার, ক্ষুদ্র ঋণ দানকারী সংস্থা, আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এবং দাতা সংস্থা বন্যা কবলিত এলাকার নিম্ল আয়ের মানুষের বড় ধরনের বন্যা ঝুঁকি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্র্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।
‘সময়ের চাহিদার আলোকে এ ধরণের উদ্যেগ বাংলাদেশে তো বটেই উন্নয়নশীল দেশে এই প্রথম। আমরা প্রাথমিকভাবে সিরাজগঞ্জে শুরু করেছি। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠনগুলো এগিয়ে আসলে পর্যায়ক্রমে দেশের বন্যাকবলিত প্রতিটি এলাকা এই প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব হবে’, বললেন নুরুল আমীন।
এই বীমা কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কে এম আলী আযম জানান, ‘আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সর্বাত্বক, এমনকি প্রয়োজনে আর্থিক সহযোগিতাও কত্রান নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং খুব অল্পসময়ে তারা অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে’। দুর্গত এলাকার বন্যার বিপদসীমা নির্ধারন, সময় ও পানির মাত্রা পরিমাপের বিষয়গুলো সরকার নির্ধারিত মাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য মত দেন তিনি।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ একটি পরিবারের ঘর-বাড়ি ভেসে যাওয়ার সাথে সাথে তাদের আশা, ভরসা আর ভবিষ্যতও ভেসে যায় বন্যার পানির সাথে। সামান্য কিছু টাকা হলেই তারা আবার নতুন করে নতুন জীবনের প্রস্তুতি নিতে পারে। বীমার মাত্র আট হাজার টাকায়ও আসমার মতো পরিবার বন্যার পরে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হবে। বীজ, সার, কীট নাশকের যোগান আসবে। গ্রামীন অর্থনীতির মূল কাঠামো কৃষিজীবি মানুষ এই অবলম্বনকে সঙ্গী করেই সোনার ফলাতে পারবে। স্বাচ্ছন্দের হাসি ফিরে আসবে প্রান্তিক কৃষকের ঘরে ঘরে।
সিরাজগঞ্জের গ্রাম ভিত্তিক বীমাভুক্ত পরিবার সংখ্যা ও বন্যার পানির বিপদসীমা:
গ্রামের নাম | ইউনিয়ন | পরিবার সংখ্যা | পরিবার সংখ্যা |
আকনা দিঘী | মেছড়া | 148 | 14.35 |
মল্লিক ও হাট পাড়া | 200 | 14.35 | |
খাশ বড় শিমুল | সয়দাবাদ | 98 | 12.80 |
চকবয়রা | 54 | 12.70 | |
ফুলবাড়ি | 119 | 12.85 | |
পঞ্চসোনা | 334 | 12.75 | |
ছোট চৌহালী | স্থল | 105 | 11.10 |
বড় চৌহালী | 56 | 11.35 | |
ফুলহারা | ঘোড়জান | 168 | 11.00 |
মুরাদপুর | 379 | 10.90 |
(তথ্য স্মারণী -১)
ন্যার মেয়াদকাল ও প্রদত্ত বীমা সুবিধা:
বিবরণ | টাকার পরিমান |
বন্যার পানি নিধারিত পরিমান উচ্চতা অনুযায়ী ১১ দিন পর্যন্ত চলমান থাকলে | ২৮০০ |
বন্যার পানি নিধারিত পরিমান উচ্চতা অনুযায়ী ২১ দিন পর্যন্ত চলমান থাকলে | ৪৪০০ |
বন্যার পানি নিধারিত পরিমান উচ্চতা অনুযায়ী ২৬ দিন পর্যন্ত চলমান থাকলে | ৮০০০ |
(তথ্য স্মারণী -২)
নোট:
মেসো লেভেল বন্যা বীমা কী:
মেসো লেভেল ফ্লাড ইন্স্যুরেন্স হলো বন্যা দুর্গত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কোন তৃতীয় পক্ষ, যেমন সরকার, দেশীয় অথবা আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদেও স্বউদ্যোগে ইন্সূরেন্স এর প্রিমিয়াম পরিশোধ করে দিবে। বন্যা দুর্গত লোকেরা এক্ষেতে বন্যাকালীন ক্ষয় ক্ষতির শিকার হলে, ইন্স্যুরেন্সের বীমার সুবিধা ভোগ করবেন।
মাইক্রো লেভেল: এটা মেসো লেভেল কনসেপ্টের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে কৃষক বা ভুক্তভোগী, বন্যাকবলিত ব্যক্তি নিজেই নিজের ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম প্রদান করবে। তবে অক্সফাম মাইক্রো লেভেল পদ্ধতিতে না গিয়ে মেসো লেভেল এরম ত দরিদ্র বান্ধব একটি ইনোভেটিভ পদ্ধতি গ্রহন করেছে।
অক্সফাম ও এসডিএস এর অর্থায়নে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডাব্লিউএম), সুইস রি, প্রগতি ইন্স্যুরেন্স এর কারিগরি সহায়তায় এবং স্থানীয় উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান মানব মুক্তি সংস্থা (এমএমএস এর সহায়তায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে জেলার চর এলাকায় প্রথম বারের মতো উদ্ভাবনি মূলক মেসো-লেভেল ফ্লাড ইন্সুরেন্স প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করেছে। এই প্রকল্পের নাম দূর্যোগ ও জলবায়ূজনিত বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠির ঝুঁকি স্থানান্তরে বিকল্প কৌশল উন্নয়ন প্রকল্প।