
প্রশ্নগুলো দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়শীল দেশগুলোর একটি সাধারণ চিত্র। সেখানে ফর্সা ত্বকের জয়জয়কার। ফর্সা ত্বকের পিছে যেন ছুটছে সবাই। যাদের ত্বক ফর্সা নয়, তারা প্রসাধনীর পিছু ছুটছে। আর যারা কালো কিংবা শ্যামলা ত্বককে মেনে নিয়েছেন -প্রসাধনী তাদের পিছে ছুটছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে উল্টে দিতে মাঠে নেমেছেন বলিউডের একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। তিনি শুরু করেছেন ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ শীর্ষক প্রচারণা। অর্থাত্, কালো মেয়েকে ভ্রুকুটি দেখিওনা। কালোরা কোনো অংশে কম সুন্দর নয়। বরং কালোরাই সমাজের আলো। নানা বৈষম্য, লাঞ্চনার মধ্যেও নিজেদের গুণ দিয়ে সমাজ আলোকিত করতে পারেন তারা।
তিনি হলেন ভারতের বহুল আলোচিত তারকা নন্দিতা দাস। এই প্রচারণার ‘পোস্টার গার্ল’ হয়েছেন তিনি নিজেই। প্রচারণায় তিনি ফর্সা মেয়েদের প্রতি সমাজের একচোখা পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই ঘোষণা করছেন। তিনি প্রচার করছেন- এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তির, পরিবারের, সমাজের এমনকি দেশের জন্যও ক্ষতিক্ষর। কেবল গায়ের রং কালো বলেই অগণিত মেয়ে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিয়েছে। অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন।
নন্দিতা কেন এমন একটি ইস্যুকে সামনে টেনে আনলেন। ফর্সা মেয়েরা তো সবদিন সমাদর পেয়ে এসেছে। নতুন করে তো কিছু ঘটেনি। বার্তা সংস্থা এএফপি নন্দিতার কাছে এমন একটি প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক নতুন করে কিছু ঘটেনি। কিন্তু প্রযুক্তি এবং শিক্ষার অগ্রসরতার সাথে সাথে এই কুসংস্কার দূর হয়ে যাবে বলে সবার আশা ছিল। কিন্তু মোটেও দূর হয়নি। ম্যাগাজিন, টিভি অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন, সিনেমা ইত্যাদি লক্ষ্য করুন। কালো মেয়েদের ঠাঁই কোথাও আছে? হাজার মেধাবী হলেও, হাজার অভিনয় পারদর্শী হলেও এসব মিডিয়ায় তারা কি সেই হারে স্থান পাচ্ছে? বড় বড় বিভিন্ন কর্পোরেট কিংবা মাল্টিন্যালশাল কোম্পানির অফিসে যান, সেখানে দেখবেন বিভিন্ন ছোট-মাঝারি-বড় পদগুলিতে কি সুন্দর করে ফর্সা মেয়েদের সাজিয়ে রাখা হয়েছে! ওইসব অফিসের নিচতলা থেকে বিশ তলা পর্যন্ত ঘুরে সম্ভবত একটাও কালো মেয়ে পাবেন না। তার মানে কি কালো হলে কি তারা মেধাহীন হয়? মেধার জোরো চাকরি পায় কেবল ফর্সা চামড়ার মেয়েরা? আসলে সাদা ত্বকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এই একুশ শতকেও বিন্দুমাত্র দূর হয়নি। বরং সচেতনার অভাবে তা আগের চেয়ে কয়েকগুণ শক্তি নিয়ে জেঁকে বসেছে।’
নন্দিতা দাসের বর্তমান বয়স ৪৩ বছর। তার নিজের গায়ের রং কালো। তবু সবাই একবাক্যে তাকে গ্ল্যামারাস হিসেবে মানে। তিনি অভিনয় করার সময় ছবির পরিচালকরা মেকআপ দিয়ে তার গায়ের রং ফর্সা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি জোরালোভাবে তা করতে অস্বীকার করেছেন। সোজা ভাষায় বলে দিয়েছেন, কালো নন্দিতাকে যদি ছবিতে দেখাতে প্রেস্টিজে বাধে তবে তিনি অভিনয় করবেন না। প্রতিবার তারই জয় হয়েছে। পরিচালকরা বাধ্য হয়েছেন ন্যাচারাল রংয়ে নন্দিতাকে দেখাতে।
‘কালোই আলো’ প্রচারণা প্রথম শুরু হয় ২০০৯ সালের মে মাসে। ভারতের শক্তিশালী নারী অধিকার গ্রুপ ‘ওমেন অব ওয়ার্থ’ এটি শুরু করে। কিন্ত নন্দিতা দাস এতে যুক্ত হবার পর এই আন্দোলনের পালে দারুণ হাওয়া লাগে। মূলত তার কারণেই সংবাদপত্র এবং টিভিতে বিষয়টি নিয়ে তর্ক বিকর্তের ঝড় ওঠে। সবাই জানতে পারছে কালো মেয়েদের পক্ষে এই লড়াইয়ের কথা।
নন্দিতা বলেন, আমি এই প্রচারণায় যুক্ত হবার পর থেকেই কিশোরী-তরুণীদের কাছ থেকে হাজার হাজার ইমেইল ও চিঠি পাচ্ছি। তারা মন খুলে জানাচ্ছে গায়ের রঙ কালো হবার কারণে কিভাবে পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনে, পথে-ঘাটে, শপিং মলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অনেকে বলছে তাদের বাবা-মাও মেয়েকে গালাগাল করছেন কালো হবার কারণে। কেউ কেউ বলছে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে!
নন্দিতা স্মৃতিচারণ করে বলেন, একবার একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে তার ছবি ব্যবহার করবে বলে ফটোগ্রাফার ছবি তুলে নিয়ে যায়। পরে ছাপা হবার পর তিনি দেখেন কম্পিউটারের কারসাজিতে তার গায়ের রঙ ফর্সা করে দেয়া হয়েছে। তিনি সম্পাদককে প্রশ্ন করেন, এটা কোন নন্দিতা? আরেকজনের ছবি দিয়ে তার সাক্ষাত্কার ছাপা হয়েছে কেন। জবাবে সম্পাদক বলেন, ম্যাডাম ওটা আরেকজনের নয়, আপনারই ছবি। ম্যাগাজিনের কভারটা ‘সুন্দর’ করার জন্য কম্পিউটারে আপনার গায়ের রঙ ফর্সা করে দেয়া হয়েছে।
নন্দিতা বলেছেন, কেউ জন্মগতভাবে ফর্সা হতে ব্যর্থ হলে বুঝতে শেখার পর পারিপার্শিকতার কারণে জোর করে ফর্সা হতে চাইছে। এই সুযোগে রং ফর্সা করা ক্রিমের বাজার ভারতে ২০০৮ সালে যেখানে ছিল ৩৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেখানে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২০১৩ সালে হয়েছে ৬৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই ক্রিমের পেছনে এই বিপুল বিনিয়োগই বলে দেয় সমাজে কালো মেয়েদের অবস্থান দিন দিন কোথায় যাচ্ছে।
নন্দিতা বলেন, ভারতীয় বংশোদভুত নিনা দাভুলুরি ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতায় সেরা সুন্দরী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কালো। ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা তখন মন্তব্য করেছিল, নিনা যদি ভারতে থাকতেন তবে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় জেতা তো দূরের কথা, বাছাই পর্বে গেলেই হয়তো বিচারকরা হাসাহাসি করতো।
তিনি বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের সমালোচনা করে বলেন, বিজ্ঞাপনে প্রায়ই দেখানো হয় একটি ফর্সা মেয়ের অনেক আত্মবিশ্বাস এবং বন্ধু থাকে। কালো মেয়েরা থাকে মনমরা হয়ে। এসব দেখে ক্ষুব্ধ নন্দিতা ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ প্রচারণা নিয়ে মাঠে নেমেছেন জোরেসোরেই। কান্ডজ্ঞানহীন ভিডিও এবং বিজ্ঞাপনে যেন ফর্সা মেয়েরাই কেবল আত্মবিশ্বাসী হয় এবং সফলতা পায় এমনটি আর না দেখানো হয় সেজন্য গণস্বাক্ষর গ্রহণ অভিযান শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে ১৫ হাজারের বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ হয়েছে। ‘ডার্ক ইজ বিউটিফুল’ টিম আরেক বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানের সমালোচনা করেছে। কারণ শাহরুখ খানও একটি রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছেন। শাহরুখ খান এই গণস্বাক্ষরে অভিযানে এখনও সই করেননি। তারা দেখার অপেক্ষায় আছে তিনি সই করেন কি না।
নন্দিতা বলেন, রঙ ফর্সা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি যারা দিচ্ছেন তারা আসলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখছেন। বিজ্ঞাপনে যেমন দেখানো হয়, সেই ‘আত্মবিশ্বাসী’ হতে মেয়েদের ফর্সা রঙ কেন প্রয়োজন সে ব্যাপারে ক্রিম উত্পাদকদের যেকোন একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির ব্যাখ্যা চেয়েছেন নন্দিতা ও তার টিম। তবে তিনি এটাও বিশ্বাস করেন, নারী পুরুষদের সমান সুযোগ তৈরী হলেই সাদার পেছনে ছোটার এই হুজুগ দূর হবে।