ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যদের যে উপহার আদান-প্রদান করা হয় তাকে ‘হাদিয়া’ বলে। কোনো মুখাপেক্ষী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের নিয়তে কিছু দেওয়াকে ‘সাদাকায়ে নাফেলা’ বলা হয়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘একে অন্যকে হাদিয়া দেবে। হাদিয়া অন্তরের কলুষ দূর করে। এক পড়শি অন্য পড়শিকে হাদিয়া দিতে যেন অবহেলা না করে, সামান্য মনে না করে, যদিও তা এক টুকরা বকরির খুর হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৩০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সাহাবিদের হাদিয়া দিতেন এবং সাহাবিরাও রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হাদিয়া দিতেন।
হাদিয়ার প্রতিদান দেওয়া উচিত
কেউ হাদিয়া দিলে তার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এতে পারস্পরিক সম্পর্ক মধুর হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যাকে দান করা হয়েছে তার সামর্থ্য থাকলে সে যেন এর প্রতিদান দেয়। যার সামর্থ্য নেই, সে যেন প্রশংসা করে। কেননা যে প্রশংসা করল, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। আর যে তা গোপন করে, সে তার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮১৩)
হাদিয়ার প্রতিদানে সমপরিমাণের জিনিস হতে হবে এমন কোনো কথা নেই; বরং নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিদান দিতে চেষ্টা করা উচিত।
হাদিয়া প্রত্যাখ্যান করা ঠিক নয়
কেউ হাদিয়া দিলে তা প্রত্যাখ্যান করা ঠিক নয়। কেননা তাতে হাদিয়াদাতার মনে কষ্ট হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক তিক্ত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যাকে সুগন্ধি দান করা হয়, সে যেন তা ফিরিয়ে না দেয়। কেননা এটি হালকা জিনিস অথচ সুগন্ধযুক্ত।’ (মুসলিম, হাদিস : ২২৫৩)
হাদিয়া সামান্য হলেও তা ফিরিয়ে না দিয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করা উচিত।
হাদিয়া ফিরিয়ে নেওয়া শোভনীয় নয়
হাদিয়া দেওয়ার পর তা ফিরিয়ে নেওয়া শোভনীয় নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে দান করে তা প্রত্যাহার করে নেয়, তার দৃষ্টান্ত এমন কুকুরের মতো, যে বমি করে পুনরায় তা গলাধঃকরণ করে নেয়।’ (বুখারি, হাদিস : ২৫৮৯)
হাদিয়া ও ঘুষের পার্থক্য
হাদিয়া ও ঘুষের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। হাদিয়া দেওয়ার নিয়তের মধ্যে পারস্পরিক মহব্বত থাকে। পার্থিব কোনো স্বার্থ হাসিল বা কোনোরূপ সাহায্য পাওয়ার আশা থাকে না। পক্ষান্তরে ঘুষ দেওয়ার উদ্দেশ্য হয় কোনো স্বার্থ হাসিল করা বা সাহায্য পাওয়া। সাধারণত কর্তব্যরত কোনো ব্যক্তির কাছে থেকে কাজ আদায় করার উদ্দেশ্যে কিছু দেওয়া ঘুষের অন্তর্ভুক্ত।
বর্ণিত আছে, নবীজি (সা.) আজদ গোত্রের এক ব্যক্তিকে সদকা আদায়ের জন্য নিয়োগ করেন। তাঁর নাম ছিল ইবনে লুতবিয়্যা। তিনি ফিরে এসে বলেন, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে নবীজি (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা আমার ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা পালনের জন্য আমি তোমাদের কোনো কোনো লোককে নিয়োজিত করি। তাদের কেউ এসে বলে, এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে হাদিয়াস্বরূপ দেওয়া হয়েছে। সে তার পিতা বা মাতার ঘরে বসে থাকেনি কেন? তখন দেখতে পেত তাকে হাদিয়া দেওয়া হয় কি না? সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ—এ ক্ষেত্রে কেউ যদি কিছু গ্রহণ করে তাহলে সে তা তার ঘাড়ে বহন করে কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হবে…। (বুখারি, হাদিস : ২৫৯৭)
পদের অধিকারী যাদের হাদিয়া গ্রহণ করতে পারে
যিনি এমন কোনো পদে রয়েছেন, যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের উপকারিতা সম্পৃক্ত, তার জন্য সাধারণভাবে হাদিয়া গ্রহণ করা বৈধ নয়। তবে তিন শ্রেণির মানুষ থেকে হাদিয়া গ্রহণের অবকাশ রয়েছে : (১) নিজের কাছের মাহরাম আত্মীয়দের থেকে। (২) যারা তাকে এ পদ লাভ করার আগেও হাদিয়া দিত, এখনো সেই পরিমাণ দেয় তাদের থেকে এবং (৩) স্বীয় পদের চেয়ে ওপরের পদবিধারী থেকে। শর্ত হলো, তার পদ দ্বারা তাদের উপকৃত হওয়ার আশা না থাকা। (দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার : ৪/৩১১)
অমুসলিমের সঙ্গে হাদিয়ার আদান-প্রদান
অমুসলিমকেও হাদিয়া দেওয়া জায়েজ আছে। অনুরূপভাবে যদি কোনো অমুসলিম মুসলিমকে হাদিয়া দেয় এবং এর দ্বারা তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য না থাকে তাহলে তা গ্রহণ করাও জায়েজ আছে। (বুখারি ও ফাতহুল বারি : ৫/২৭৫-৭৬)
হাদিয়াদাতার আয়ের উৎস হারাম হলে
হাদিয়াদাতার আয়ের সব উৎস হারাম হলে তার হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েজ নয়। যদি তার বেশির ভাগ আয় হারাম হয় এবং সে হাদিয়া দেওয়ার সময় উল্লেখ না করে যে হালাল আয় থেকে দিচ্ছে না হারাম আয় থেকে তাহলেও তা গ্রহণ করা জায়েজ নয়। যদি স্পষ্ট উল্লেখ করে যে এ হাদিয়া হালাল আয় থেকে, তাহলে তা গ্রহণ করার অবকাশ আছে। যদি বেশির ভাগ আয় হালাল হয়, তাহলে হালাল-হারাম স্পষ্ট না করলেও হাদিয়া গ্রহণ করা জায়েজ আছে। তবে বেশির ভাগ আয় হালাল—এমন ব্যক্তির হাদিয়ার ব্যাপারে যদি জানা যায় যে হাদিয়া হারাম আয় থেকে দিচ্ছে তাহলে তা গ্রহণ করা বৈধ নয়। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ৫/২৪২-৪৩)
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া, কারওয়ান বাজার, ঢাকা।