শরতের নীল আকাশ, তুলোর মতো সাদা মেঘ আর ভোরবেলার শিউলি ফুল। সবই যেন জানান দিচ্ছে, মা দুর্গা আসছেন। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এ বছর ২১ সেপ্টেম্বর (রবিবার) মহালয়ার মাধ্যমে দেবীর আগমনবার্তা শুরু হয়েছে। আর এর মধ্যে দিয়ে বাংলার আকাশ-বাতাসে এখন শুধু পুজোর আমেজ। ঢাকের আওয়াজ, ধূপের গন্ধ আর সাজসজ্জায় ভরে উঠছে প্রতিটি পাড়া-মহল্লা।

দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়। এটি বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি আর সামাজিক সম্প্রীতির অন্যতম প্রতীক। হিন্দু সম্প্রদায়ের সীমায় না থেকে আজ এটি সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে। গ্রাম থেকে শহর, ছোট মহল্লা থেকে বড় আয়োজন। সর্বত্র চলছে পুজোর প্রস্তুতি। প্রতিমা গড়ার কারিগরদের ব্যস্ত হাত, মণ্ডপ সাজানোর কর্মযজ্ঞ আর মানুষের উৎসাহে এখন চারিদিক উৎসবমুখর।
মহালয়া দিয়ে সূচনা
মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের শুরু। চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া হিসেবে পরিচিত। আর এই চন্ডীতেই আছে কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে দেবী দুর্গার। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মহালয়া।
তবে মহালয়ার আর একটি দিক হচ্ছে- এই তিথিতে যারা বাবা-মা ছাড়া তারা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকেই বলা হয় মহালয়া।
রোববার ভোরে চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে আবাহন ঘটে দেবী দুর্গার। দেবীকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মর্ত্যলোকে। আগামী রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূলত আজ থেকেই পূজার্থীরা দুর্গাপূজার আগমনধ্বনি শুনতে পাবেন।
বিশ্বাস করা হয় এই দিন দেবী মহিষাসুর বধ করতে মর্ত্যে আগমন করেন। মহালয়ার গান আর চণ্ডীপাঠ বাঙালির হৃদয়ে বিশেষ আবেগ জাগায়।
উৎসবের সামাজিক রূপ
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা আজ দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক উৎসবগুলির একটি। প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মণ্ডপে এ উৎসব হয়। একসময় জমিদারদের আয়োজনে সীমিত থাকলেও এখন এটি সব শ্রেণির মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। পূজা মানে শুধু ভক্তি নয়, সঙ্গে নাটক, গান, আবৃত্তি, মেলা আর নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন।
দেবীর বার্তা
দুর্গা কেবল অসুরবধিনী নন। তিনি শক্তি, ন্যায় আর সাহসের প্রতীক। তাঁর হাতে অস্ত্র মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই, তাঁর আগমন মানে শুভ শক্তির জয়। বর্তমান সমাজেও এই বার্তা গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।
শিগগিরই ঢাকের শব্দে, উলুধ্বনিতে আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হবে চারদিক। প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে আনন্দ, ভ্রাতৃত্ব আর সম্প্রীতির বার্তা। সত্যিই দরজায় কড়া নাড়ছেন দেবী দুর্গা।
পূজার তারিখগুলো এক নজরে
- ২৭ সেপ্টেম্বর (পঞ্চমী) – খুঁটি পূজার মধ্য দিয়ে মণ্ডপে পূজার আনুষ্ঠানিক শুরু।
- ২৮ সেপ্টেম্বর (ষষ্ঠী) – দেবীর অকালবোধন। দেবীর মর্ত্যে আগমনের প্রতীক।
- ২৯ সেপ্টেম্বর (সপ্তমী) – নবপত্রিকা স্নান ও দেবী পরিবারের আবাহন।
- ৩০ সেপ্টেম্বর (অষ্টমী) – মহাঅষ্টমী ও সন্ধিপূজা। এই দিন দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন বলে বিশ্বাস। ভক্তরা নতুন পোশাক পরে পুষ্পাঞ্জলি দেন।
- ১ অক্টোবর (নবমী) – মহিষাসুর বধের চূড়ান্ত পর্ব। মহাআরতি আর চণ্ডীপাঠে মণ্ডপ ভরে ওঠে।
- ২ অক্টোবর (দশমী) – বিসর্জন ও বিজয়া। দেবীর কৈলাসে ফেরার দিন। সিঁদুর খেলা, মিষ্টিমুখ আর শুভেচ্ছা বিনিময়ে শেষ হয় উৎসব।