জাহিদ আল আমীন, হাওরাঞ্চল থেকে ফিরে : মঙ্গা বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের কথা। কিন্তু দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরাঞ্চলের মঙ্গা পরিস্থিতি উত্তরবঙ্গ থেকে কোনো অংশে কম নয়। হাওরাঞ্চলে প্রতি বছরের কার্তিক ও চৈত্রমাসে েেতর ফসল ফুরিয়ে আসে। তখন বিকল্প কোনো কাজের সংস্থান না থাকায় সেখানকার প্রায় এক পঞ্চমাংশ মানুষকে অনাহারে, অর্ধাহারে কাটাতে হয়। । গ্রামীন জীবনযাত্রা স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল) এর উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ হাওর উন্নয়ন বোর্ড এবং সিএসআরএল এর তথ্যমতে, আকস্মিক ঘুর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢল, ঘণ ঘণ বন্যা, পাকাধানে শিল পড়া, দীর্ঘ মেয়াদী খরার মত প্রাকৃতিক বন্যার ফলে হাওরাঞ্চলের প্রতি তিন বছরে এক বছর ফসল নষ্ট হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুম এলেই হাওরগুলো কানায় কানায় ভরে যায়। প্রায় সাতমাস জলবন্দি হয়ে থাকে হাওর পাড়ের মানুষেরা। শীতের শুরুতে পানি নেমে গেলে হাওর এলাকা পরিণত হয় শুষ্ক ও উর্বর ভূমিতে। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর অববাহিকায় বিস্তীর্ণ এই জনপদসমূহে কৃষকরা প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধুমাত্র একটি ফসল তথা বোরো ধান উৎপন্ন করতে সম হয়। হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং দুর্বল যোগাযোগ অবকাঠামোর কারণে এখানকার অধিবাসীরা দেশের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত জনগণ। বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় কোন ফসল উৎপন্ন না হওয়ায় চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মাঝে তাদের দিনাতিপাত করতে হয়। নিরব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া দুই কোটি হাওরবাসীর মুক্তির কোন পথই যেন খোলা নেই। ফলে জলবন্দি মানুষগুলো ভিন্ন একরকম মঙ্গার শিকার।
খাদ্য নিরাপত্তার উপায় নির্ধারণের জন্য হাওর অঞ্চলের অর্থনীতির এবং মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানা এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণগুলো অনুসন্ধানের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার কৌশল খুঁজে বের করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তত্ত্বাবধানে “হাওর অঞ্চলে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা : বর্তমান প্রোপট ও ভবিষ্যৎ করণীয়” শীর্ষক এক গবেষণা সম্পন্ন হয়। এ গবেষণায় উঠে এসেছে হাওরাঞ্চলের খাদ্য ঘাটতির মূল কারণগুলো। এখানকার অধিকাংশ জনগণই অশিতি ও মৌসুমি বেকার। বছরে একটিমাত্র শস্য উৎপাদন, বেকারত্ব, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পর্যাপ্ত সহায়তার অভাবের ফলে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রকোপ ক্রমশ: বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অঞ্চলের কত শতাংশ মানুষ ২৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে, যা দেশের সার্বিক অবস্থারও নীচে। এখানে বেকারত্বের হার ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ওই গবেষণায় দেখা গেছে, হাওর অঞ্চলের ৮০ শতাংশ পরিবার জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করলেও মাত্র ১০ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করতে পেরেছে এবং ২ শতাংশ পরিবার ঋণ ফেরত দিয়েছে। এখানকার প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাজার থেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাজার অনেক শক্তিশালী এবং এর আওতা অনেক বেশি। এ কারণে মহাজন শ্রেণীর ঋণ দাতা উচ্চ সুদে ঋণ সরবরাহ করে থাকে। মূলত খাদ্য ক্রয় এবং শস্য উৎপাদনের খরচ মেটানোর জন্য অধিকাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করে থাকে। প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবার নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে ঋণ জালে জড়িয়ে যায়। এ অবস্থার মূল কারণ অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ বাজারের উচ্চ সুদের হার এবং প্রাতিষ্ঠানিক বাজার থেকে ঋণ প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় জামানত ও কাগজপত্র প্রদানের জটিলতা।
হাওর গবেষক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পোভার্টি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক, ড. মোহাম্মদ মিজানুল হক কাজল জানান, হাওর এলাকায় ফসলের মৌসূমে ৮৮ শতাংশ মানুষ সহজে চাল সংগ্রহ করতে পারলেও, মন্দা সময়ে ৭৪ শতাংশ মানুষ সহজে চাল সংগ্রহ করেছে। অধিকাংশ পরিবারেই সাধারণ ও মন্দা উভয় মৌসুমেই খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে ব্যবহার করে। সাধারণ মৌসুমে ৫৯ শতাংশ মানুষ চাল ক্রয় করলেও মন্দা মৌসুমে ৬৬ শতাংশ মানুষ চাল ক্রয় করে ব্যবহার করে। সাধারণ মৌসুমে সব ধরনের খাদ্যই মন্দাকালীন সময়ের চেয়ে সংখ্যায় অধিকবার গ্রহণ করে। সাধারণ সময়ে পরিবারের সব সদস্যরা সকাল, দুপুর ও রাতে খাবার গ্রহণ করলেও মন্দা মৌসুমে অধিকাংশ পরিবার দুপুরে খাদ্য গ্রহণ না করে ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রহ করে রাখে। অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে মন্দা মৌসুমে খাদ্য অভাবের প্রভাব দরিদ্র পরিবারের ওপর প্রকটভাবে ল করা যায়। এ কারণে দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা ধনী পরিবার থেকে বেশি করে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকে।
অক্সফাম জিবি’র হিউমেনিটারিয়ান ক্যাম্পেইন কর্মকর্তা ও হাওর গবেষক তাপস রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, হাওরাঞ্চলে ৪৫ শতাংশ খানা স্বাভাবিক, ২৯ শতাংশ মাঝারি ধরনের এবং ১৯ শতাংশ পরিবার চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণ হিসেবে ভূমিহীনতা, এক ফসল চাষ, মৌসুমি বেকারত্ব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই প্রধান কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করেন।
তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের নিবিঢ় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশই স্থানীয় মহাজন শ্রেণীর ঋণ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করে খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থা মোকাবেলা করেছে। এ প্রেেিত অধিকাংশ পরিবার ঋণের দুষ্ট চক্রে জড়িয়ে পড়ে এবং চরম ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে নিপীড়িত জীবনযাপন করে। খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থা থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে সারা বছর কাজের সুযোগ এবং সরকারি সহায়ক কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
এ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনোমিক ডেভলপমেন্ট (এ্যাসেড) এর প্রধান নির্বাহী জাফর ইকবাল চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক নয়। যদিও এ বিষয়ে কাজের কৌশল প্রয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত যেমন- শিা, কাজের সুযোগ, বাসস্থান, শৌচাগার সুবিধাদি, উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুবিধা ইত্যাদি। এসব সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামীণ এলাকা থেকে হাওর এলাকায় অনেক শোচনীয় অবস্থায় আছে।
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবেলার জন্য নিরাপত্তা বেষ্টনী ও আয়বর্ধক কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তাও গুরুত্বপূর্ণ। এ েেত্র প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে পরিলতি হয় প্রায় ২০ শতাংশ পরিবার ভিজিএফ, ভিজিডি এবং অন্য কর্মসূচির আওতায় নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতা থেকে সাহায্য পেয়েছে। এখানে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র পরিবারের সাহায্য প্রাপ্তির েেত্র একটি বিশেষ চিত্রের পরিস্ফুটন পরিলতি হয় বলে তিনি মনে করেন।
হাওরবাসী রক্ষায় নাগরিক উদ্যোগ এর আহবায়ক নির্মল ভট্টাচার্য বলেন, হাওরাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা নিরসনে সিএসআরএল উদ্যোগে আমরা একগুচ্ছ সুপারিশ প্রণয়ন করেছি। যার মধ্যে রয়েছে – ব্যাপক ও টেকসই প্রচলিত ও অপ্রচলিত পদ্ধতির শিব্যবস্থা গ্রহণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা গ্রহণ, খাদ্য ব্যাংক গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক অভিবাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বহু ফসল উৎপাদন এবং সমন্বিত খামার ব্যবস্থার জন্য গবেষণা প্রকল্প প্রণয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং শস্য সংরণের জন্য নতুন নতুন বাঁধ তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বিস্তৃতি করা।
বার্তাবাংলা ডেস্ক »
শেয়ার করুন »