বার্তাবাংলা ডেস্ক »

বাসনা ছিল গানের দল করার, তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে গানের প্রতি ভালোবাসা আজও ছাড়তে পারেননি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে গুনগুনিয়ে গান করেন। একজন গাইলে অন্যজন শুনেন। এরপর তিনিও আবার গাইতে শুরু করেন।

মাঝে মধ্যে মৃদু ভাষায় চলে অল্প-স্বল্প কথা। মন খুলে কথা আজও বলা হয়নি। যে কেউ এগিয়ে গেলেই তাদের প্রতি মনে সন্দেহ জাগে। এরই মধ্যেই হয়তো কাউকে বিশ্বাস করেন, আবার তা ভেঙেও ফেলেন অচিরেই। এভাবেই অবিশ্বাস আর সন্দেহের বেড়াজালে বন্দি রাজধানীর মিরপুরের বহুল আলোচিত সেই ‘ভূতের বাড়ি’র দুইবোন রিতা-মিতার দিনলিপি।

ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাদের। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৩১৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ‘রহস্যাবৃত’ এই দুই নারী। বয়স বাড়ছে, নুয়ে পড়ছে শরীরের গাঁথুনিও। বড় বোনের চেয়ে ছোট বোন একটু বেশিই শীর্ণকায়। জীবনের মতো ওষুধ-পথ্যেও অনীহা তাদের, খাওয়া-দাওয়া একেবারে সীমিত।

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা মিলল রিতা-মিতার। প্রথমে কথা বলতে একেবারেই নারাজ। অবশ্য পরে কিছুটা শান্ত হন। ডা. আইনুন্নাহার রিতা, যিনি বয়সে বড়। হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন তিনি। তার পাশেই ছিলেন ছোটবোন প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতা। আলাদা বেড থাকলেও বড়বোনের কাছে এসেই বেশিরভাগ সময় শুয়ে-বসে গল্প করেন তিনি। তবে কথা হয় খুব আস্তে আস্তে, যেন আশপাশের কেউ তাদের কথা না শোনে।

সেই সঙ্গে চোখ বড় বড় করে আশপাশে দৃষ্টি, কেউ তাকিয়ে আছে কিনা কিংবা শুনে ফেলছে কিনা! হাসপাতালের বেডের খুব কাছে গিয়ে কথা হয় রিতার সঙ্গে। কেমন আছেন আপনি? জানতে চাইলে বললেন, ‘এমনিতে ভালো আছি। তবে আমাদের দুইবোনেরই শারীরিকভাবে খুব দুর্বল লাগে। আমরা তো মানসিক রোগী না! তবে কেন হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, তা বুঝতে পারছি না।’

সারাদিন কী করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে খুব আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমার বোন আমাকে গান শোনায়, আমি তাকে গান শুনাই আর সারাদিন গল্প করি।’ এ সময় গানের দল করার ইচ্ছার কথাও জানালেন তিনি। তবে এরমধ্যেই হঠাৎ করে বলে ওঠেন, ‘আর বেশি কথা বলা যাবে না। আমার বোন সবার সঙ্গে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছে।’

পাশেই থাকা নুরুন্নাহার মিতার কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেমন আছেন? তবে এতে কোনো সাড়া দেননি এই নারী। নিজ মনেই পুরাতন খবরের কাগজ দিয়ে নিজের ব্যবহারের জুতোজোড়া মুড়িয়ে রাখছিলেন। ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্স রেহেনা খাতুন জানালেন, কিছুক্ষণ আগেই তাদের ইসিজি (ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফি) করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মাত্র ওয়ার্ডে আনা হলো।

তিনি বলন, ‘সারাদিন দুইবোন খুব শান্ত থাকেন। নিজেদের মধ্যেই আস্তে করে কথা বলেন তারা। মাঝে মাঝে গানও গান। তবে ওষুধ খাওয়াতে গেলেই ক্ষেপে যান।’

একই ওয়ার্ডেই নাতনির চিকিৎসা নিতে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে এসেছেন সমেহের খাতুন। তার ভাষ্য, দুইবোন নিজেদের মতো থাকেন। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। ‘তবে দুইবোনকেই শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। দুর্বলতার কারণে আজও একবার পড়ে যান একজন।’ মাঝে মাঝে রিতা-মিতার বড়বোন কামরুন্নাহার প্রায়ই খাবার নিয়ে হাসপাতালে আসেন বলে জানান সমেহের খাতুন।

২০০৩ সালে মায়ের মরদেহ বাড়িতে দাফনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রিতা-মিতার অস্বাভাবিক জীবনযাপনের বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর ২০০৫ সালে ‘ভূতের বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের ওই বাড়ি থেকে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী আইনজীবী এলিনা খানের সহযোগিতায় তাদের উদ্ধার করা হয়।

এর আগে প্রায় নয় বছর ওই বাড়িতে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছিলেন তারা। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ২০১০ সালে তাদের বড়বোন কামরুন্নাহারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপরে ২০১৩ সালে বগুড়ার একটি হোটেল থেকে তাদের উদ্ধার করে জেলার সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা হয়।

মাঝে কিছুটা সুস্থ্য হলেও সম্প্রতি অসুস্থ হওয়ায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাদের। হাসপাতালের কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, আগের ঘটনা উল্লেখ করলে বলতে হবে ছোটবোন মিতা সিজোফ্রেনিয়ার রোগী।

‘প্রথমে এই রোগে মিতা আক্রান্ত হন। পরে রিতা তার বোনের কাছ থেকে শেয়ার ডেলিউশনে আক্রান্ত হন। মারাত্মক ধরনের মানসিক রোগী দুজনই। চারপাশে থাকা সবাইকে সন্দেহ করেন তারা।’ তিনি বলেন, পরিবারের লোকজন একটু সচেতন হলে এবং এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই চিকিৎসা দেয়া গেলে খুব সহজেই ভালো হওয়া সম্ভব। এই দুইবোনের ক্ষেত্রেও শুরুর দিকে চিকিৎসা দেয়া হলে এমনটা হতো না।

তিনি আরও বলেন, ‘দুইবোন এক সঙ্গেই থাকেন, সারাদিন গল্প করেন। তবে ওষুধের প্রতি তাদের চরম অনীহা। দুইবোনকে আলাদা রেখে চিকিৎসা দিলে অনেকটা ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। বিদেশে এ ধরনের রোগীদের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক দল থাকে, যারা রোগীর সব ধরনের ফলোআপ করে থাকে।’

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »