বার্তাবাংলা ডেস্ক »

তুনাজ্জিনা শাহরীন পেশায় চিকিৎসক। ইন্টার্ন চলাকালে প্রায়ই হাসপাতালে রোগী দেখতে দেখতে রাত ১১টা পার হয়ে যেত তাঁর। তখনই সমস্যার শুরু। বেইলি রোডের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেখানে কোনোভাবেই রাত ১১টার পর ঢুকতে দেওয়া হতো না। তাই অনেক দিন হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তারদের জন্য নির্ধারিত কক্ষেই রাত কাটাতে হয়েছে শাহরীনকে। সকালে বাসায় ফিরতে হয়েছে। কখনোবা আশ্রয় নিতে হয়েছে আত্মীয়ের বাসায়।

একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিবেদক সাদিকুর রহমান। সম্প্রতি এক আত্মীয় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে রাত ১০টার দিকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। কিন্তু ১১টায় বাসার গেট বন্ধ হয়ে যাবে বলে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আর হাসপাতালে থাকা হয়নি তাঁর। শেষে তড়িঘড়ি বাসায় ফেরেন। যেদিন রাতে অফিসে কাজ থাকে, সেদিনও সমস্যা হয়। দুশ্চিন্তা থাকে—বাসায় ঢুকব কী করে?

রাজধানী ঢাকায় প্রায় দুই কোটি লোকের বাস। বেশির ভাগই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। ভাড়া বাসায় রয়েছে নানা ধরনের বিধিনিষেধ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাসায় ফেরা তার মধ্যে একটি। বেশির ভাগ অঞ্চলের বাড়িতেই রাত ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ভাড়াটেদের ফিরতে হয়। এর চেয়ে দেরি হলেই পোহাতে হয় ঝক্কি। অনেক বাসায় বাড়িওয়ালারা নিয়মই করে দিয়েছেন যে চাকরি বা অন্য কোনো কারণে যদি কারও নিয়মিত বাসায় ফিরতে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়, তবে তাকে আর বাসা ভাড়াই দেওয়া হবে না।

শেওড়াপাড়ায় মোয়াজ্জেম হোসেনের ফ্ল্যাট আছে। সেই ফ্ল্যাটটি তিনি এখন ভাড়া দিতে চাইছেন। আগেই শর্ত দিয়েছেন, রাত ১১টার মধ্যে ভাড়াটেকে বাসায় ফিরতে হবে। এর কারণ কী—এ প্রশ্নের জবাবে মোয়াজ্জেম বলেন, নিরাপত্তা একটি কারণ। আরেকটি কারণ হলো নিয়ম। ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া সব পরিবারকে একই নিয়মের আওতায় রাখাই মূল উদ্দেশ্য। তবে জরুরি প্রয়োজনে ভাড়াটেরা দুই-এক দিন রাত ১১টার পর ফিরলে তা মেনে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, মাসে ১৫ দিনই দেরি করে আসবে—এমন ব্যক্তিকে ভাড়া দেওয়া হয় না।

এদিকে মোহাম্মদপুরের ফ্ল্যাট মালিক রাইসুল ইসলাম বলেন, রাত ১১টার মধ্যে তাঁদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ভাড়াটেদের ঢোকার নিয়ম। কখনো এর দেরি হলে দায়িত্বে থাকা দারোয়ানকে জানাতে হয়।
তবে নিয়মিত দেরি হলে সেই ভাড়াটেকে রাখা কিছুটা সমস্যা। অনেক অভিযোগ আসে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির কাছ থেকে। এ কারণে এর আগে একবার এক ভাড়াটেকে তুলে দিতে হয়েছিল বলেও জানান রাইসুল ইসলাম। তিনি বলেন, দারোয়ান একজন। তাঁর পক্ষে ২৪ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব হয় না। তাই হয়তো এমন নিয়ম করা হয়েছে। তা ছাড়া সবাই তো করছে। এটিও একটি কারণ।

ইস্টার্ন প্লাজার পেছনে বাড়ি রয়েছে কবির হোসেনের। রাত ১২টার পর কোনো ভাড়াটে সেই বাসায় ঢুকতে বা বের হতে পারেন না। বাসার গেটে তালা দেওয়া থাকে। চাবি থাকে বাড়িওয়ালার কাছে। এ ব্যাপারে সেই বাড়িতে নিয়ম বেশ কড়া। বেশি প্রয়োজন হলে রাত ১২টার পর ঢুকতে বা বের হতে হলে আগে থেকেই দেন-দরবার করতে হয়। কবির বলেন, নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন নিয়ম।

রায়ের বাজারের বাড়ির মালিক ইমরান খান। তাঁর বাড়ির সবগুলো ফ্ল্যাটই পরিবারের কাছে ভাড়া দেওয়া। সেখানে রাত ১২টার মধ্যে বাড়িতে ফেরার নিয়ম। সবগুলো পরিবারের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই এই নিয়ম করা হয়েছে বলে জানান ইমরান। তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনে কখনো কখনো এর ব্যত্যয় হয়। কিন্তু যাঁদের নিয়মিত বাড়ি ফিরতে রাত ১২টা পেরিয়ে যায় তাঁদের ভাড়া দেওয়া হয় না।

রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা-ছয়টা পর্যন্ত বাড়ির গেট বন্ধ থাকে। এরপর আবার ভাড়াটেদের আসা-যাওয়া স্বাভাবিক থাকে বলে দাবি করেন ইমরান। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাড়ি ফেরার নতুন কোনো সময় তাঁরা ঠিক করেননি। আগের সময়ই চলছে। এ ব্যাপারে পুলিশ কখনো কিছু বলেনি বলে জানান তিনি।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সুস্মিতা তাশফিন। ভাড়া বাসায় ফেরার নির্ধারিত সময়ের কড়াকড়ি নিয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার পর এ বিষয়ে আরও কঠোর হয়েছেন বাড়িওয়ালা। এমনকি রাতে পরিচিত ব্যক্তিদের বাসায় দাওয়াতে যাওয়াও এখন বাদ দিতে হচ্ছে। কারণ, ফিরতে দেরি হলে বাসায় ঢুকতে হাজারো ঝামেলা পোহাতে হয়।

এমন নিয়মে বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী বা দারোয়ানদের হম্বিতম্বি অনেক বেড়ে গেছে বলে মন্তব্য করলেন একটি কল সেন্টারে চাকরি করা ফয়সাল আজিম। তিনি বলেন, পেশাগত বা অন্য কোনো কারণে বাসায় ঢুকতে দেরি হলে আগে থেকেই দারোয়ানদের তুষ্ট করতে হয়। চালু হয়েছে বকশিশ। কেউ বাড়িওয়ালার বিরাগভাজন হয়ে বাসা ছাড়ার নোটিশ পেতে চায় না।

বাড়িওয়ালার বেঁধে দেওয়া সময়ের পর আত্মীয়স্বজনদের বাসায় ঢোকাতে নানা ঝামেলা হয় বলে অভিযোগ করেন চিকিৎসক তুনাজ্জিনা শাহরীন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যানজটের ওপর তো কারও হাত নেই। কিছুটা দেরি হতেই পারে। কিন্তু তখন বাড়ির দারোয়ানদের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। অনেক সময়ই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আত্মীয়দের।

ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বলেন, এখন বাড়িওয়ালারা এ ব্যাপারে আরও কঠোর হচ্ছেন। পেশাগত প্রয়োজনে একজন ডাক্তার, সংবাদকর্মী, পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স-চালককে গভীর রাতেও বাইরে থাকতে হতে পারে। এই বিষয়টি বাড়িওয়ালাদের বুঝতে হবে। একটি নিয়ম বানিয়ে শুধু চাপিয়ে দিলে তো হবে না। সবক্ষেত্রে তা মানা যাবে না।

রাতে বাসায় ফেরার বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে বাড়িওয়ালারা নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এটিই একমাত্র উপায় নয় বলে মনে করেন মো. বাহারানে সুলতান। তিনি বলেন, অনেক বাড়িতে একজন নিরাপত্তারক্ষী থাকেন। ফলে তাঁর পক্ষে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা সম্ভব হয় না। নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বাড়ালে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। শুধু ভাড়াটেদের ওপর দায় চাপালে হবে না।

শেয়ার করুন »

মন্তব্য করুন »