বার্তাবাংলা রিপোর্ট :: একটা সময় ছিল যখন মানুষ রূপচর্চার জন্য প্রকৃতি সৃষ্ট উপাদান ব্যবহার করতো। কিন্তু ক্রমাগত যুগের চাহিদা মেটাতে মানুষকে রাসায়নিক সামগ্রীর দিকে ঝুকতে হয়। আর এই রাসায়নিক রূপচর্চার যুগে প্রতিটি প্রসাধনসামগ্রী উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানই তাদের ফর্মুলা গোপন করার নামে ভোক্তাদের জানতে দিচ্ছে না যে তারা প্রসাধনসামগ্রীতে আসলে কি ব্যবহার করছে। অথচ মার্কেট-মিডিয়া এবং মিলিটারির এই যুগসন্ধিক্ষণে হলিউড থেকে শুরু করে হালের বলিউডের বিভিন্ন তারকা অনায়াসেই বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন মিডিয়াতে। আর তা দেখে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তা শ্রেনী।
গতবছর যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন কিছু ক্ষতিকর রাসায়নিক ও খনিজ পদার্থের নাম প্রকাশ করে। যে পদার্থগুলো ব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন মানুষের শরীরে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পরছে। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায় ‘মিকা’ নামের একটি খনিজ পদার্থের নাম। যা বিশ্ববিখ্যাত সব প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানই তাদের পণ্যে ব্যবহার করে থাকে। আর এই খনিজ পদার্থটি সবচেয়ে বেশি উত্তোলিত হয় দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভারতে।
মিকা উত্তোলনের জন্য গোটা ভারতেই বিপুল সংখ্যক শিশু শ্রমিক ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি ড্যানওয়াচ নামের একটি সংস্থা জানায়, ভারতের পূর্বের রাজ্য ঝাড়খন্ড এবং বিহারে ‘মিকা’ উত্তোলনের কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হয়। তারা যে খনিজ পদার্থ উত্তোলন করে তা বিশ্বের মোট ১২টি উল্লেখযোগ্য রূপচর্চা সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে যায়। লরেল এবং ইসটে লাওডারের মতো নামি প্রতিষ্ঠানও ভারত থেকে মিকা কেনে।
সংস্থাটির কর্মকর্তা লুইস ভোলার একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, অবৈধভাবে মিকা উত্তোলনের কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। শিশুশ্রম ভারতের জন্য এখনও বিশাল সমস্যা। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের ভোক্তাদের জানায় না যে তারা ঠিক কি কি পদার্থ ব্যবহার করছে তাদের পণ্যে এবং তা কোথা থেকে আসছে।’তাহলে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে প্রসাধনী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সজ্ঞানেই মানুষের শরীরে একটি ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করাচ্ছে, বিনিময়ে তারা লুটে নিচ্ছে বিশাল অংকের মুনাফা।
ঝাড়খন্ডের কোদেরমা খনিটি একটি পরিত্যাক্ত খনি। প্রায় দুই দশক আগেই এই খনিটিকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। কিন্তু পরিত্যাক্ত ঘোষণা করার পরেও একদল ব্যবসায়ি মুনাফার আশায় গোপনে শিশুদের দিয়ে ওই পরিত্যাক্ত খনি থেকে মিকা সংগ্রহের কাজ করাচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমটির অনুসন্ধানী দলের সঙ্গে এরকম একজন শিশু শ্রমিক অজয় দাসের (৫) সঙ্গে কথা হয়। অজয় একটি চিকন গর্তের ভেতর নিজের শরীর ঢুকিয়ে এক হাতে হাতুড়ি ও অন্য হাতে গ্যাস কাটার দিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ করে যাচ্ছে। সপ্তাহে ছয়দিন প্রায় দশঘণ্টা করে কাজ করতে হয় তাকে। পাথর থেকে মিকা বের করার সময় যে গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা ক্রমশ অজয়ের ফুসফুসকে আক্রান্ত করে ফেলেছে। কথা বলার সময় ক্রমশ শুকনো কাশি দিচ্ছিল সে। তারপরেও সপ্তাহের শেষে পারিশ্রমিক হিসেব বিশ রুপি পেয়েই সে অনেক খুশি। কারণ অজয়ের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি, সে যে কাজটি করছে তা উন্নত বিশ্বের অনেক মানুষই অনেক টাকা পারিশ্রমিক স্বত্ত্বেও করতে চাইবে না। কারণ এই পেশায় স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
ঝাড়খন্ডের চরকি খনি পার্শ্ববর্তী স্কুল শিক্ষক রমলাখান পাসওয়ান বলেন, ‘এই খনিগুলো দুই দশক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আর তখন থেকেই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের গরীব জনগোষ্ঠি এই খনিগুলো থেকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ উত্তোলনের কাজ করে। কারণ এখানে তাদের সংসার চালানোর মতো অন্য কোনো কাজ নেই বললেই চলে। আর এই কাজ করতে গিয়ে প্রায়শই অনেকে মারা যায়। এমনও হয় যে বাবা-মার সঙ্গে বাচ্চা খনিতে কাজ করতে এসেছে কিন্তু খনির মধ্যে আটকা পরে শিশুটি মারা গেছে। শুধু তাই নয়, যে শিশুরা এই খনিগুলোতে কাজ করে তারা প্রায় সবাই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। ’
প্রায় পাঁচ বছর আগে মিনার কারুর(২৫) স্ত্রী খনিতে কাজ করার সময় মারা যায়। কিন্তু এতোকিছুর পরেও খনিতেই কাজ করতে হয় মিনারকে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় তার জানা নেই জীবিকা নির্বাহের জন্য।
ফেসপ্যাক, মাশকারা, আইলাইনার, লিপস্টিক এবং নেইলপলিশ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় মিকা। মূলত রাসায়ানিক উপাদানে তৈরি প্রসাধন সামগ্রীতে মানবদেহে বিভিন্ন রোগের (ক্যান্সার) সৃষ্টি হওয়ার কারণে প্রাকৃতিক উপাদানের চাহিদা বেড়ে যায়। যে কারণে মিকার চাহিদাও বাড়ে। ভারতের খনি কর্তৃপক্ষের মতে, ভারত প্রতিবছর ১৫ হাজার টন মিকা উৎপাদন করে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ২০১১-১২ সালের দিকে ভারত এক লাখ ত্রিশ হাজার টন মিকা রপ্তানি করেছে। আর এর পুরোটাই যে অবৈধভাবে উত্তোলিত মিকা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারতের উত্তোলিত মিকার সবচেয়ে বড় বাজার চীন। মূলত চীন থেকেই মিকা পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানে যায়। পরিবেশের কথা চিন্তা করে দুই শতাব্দী আগেই খনি থেকে মিকা উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু উন্নত বিশ্বের চাহিদা এবং মুনাফার কারণে মিকা উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি ভারত।