বার্তাবাংলা ডেস্ক::ঘটনাটি ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই তারিখের। ৩৬ বছর বয়সী এক জার্মান সেনা অফিসার, কর্নেল ক্লজ শেন্ক গার্ফ ভন স্টাফেনবার্গ, পূর্ব প্রুশিয়ার গহীন জঙ্গলে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে ঘেরা এক সেনাঘাঁটিতে পৌঁছুলেন। তার মিশন, অ্যাডলফ হিটলারকে হত্যা করা।
দ্য ওলফসেনজ্ অথবা ওলফ’স লায়ার ছিল হিটলারের গোপন ঘাঁটিগুলোর মধ্যে একটি। এই ঘাঁটির অবস্থান ছিল জার্মানির পূর্বাঞ্চলে। স্টাফেনবার্গের কাজ ছিল ফুয়েরার হিটলারসহ জার্মানির অপরাপর হাই কমান্ডের বক্তব্য সংগ্রহ করা এবং সংশ্লিষ্ট মহলে ছড়িয়ে দেয়া। সে সূত্রে সবখানেই তার ছিল অবাধ যাতায়াত। কিন্তু অন্যান্যবারের চেয়ে এবার ওলফসেনজে আসার কারণ ছিল ভিন্ন। এবার স্টাফেনবার্গ তার ব্রিফকেসে একটি বোমা নিয়ে এসেছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক জার্মান সেনা অফিসার জেনারেল ওয়াল্টার ওয়ার্লিমন্ত বলেন, ‘আমরা বুক চিতিয়ে দাড়িয়ে ছিলাম। হিটলার আসলেন। এরপরই শুরু হলো সেমিনার। হঠাৎ করেই সেমিনার হলের দরজা খুলে গেল এবং আমি একবার ঘুরে তাকালাম। দেখতে পেলাম, এক কর্নেল ভেতরে ঢুকলেন। তিনি আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। তার ডান চোখ কালো কাপড়ের পট্টি বাধা ছিল, আর ডান হাতটি ছিল কাটা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাকে দেখে আমার জাতসৈনিক বলে মনে হচ্ছিল। হিটলার ভাবলেশহীন ভাবে কর্নেলের দিকে তাকালেন। জেনারেল কেতেইল কর্ণেলকে হিটলারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।’
স্টাফেনবার্গ ছিলেন একজন অভিজাত বংশের সন্তান, ধর্মবিশ্বাসে ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং উচ্চকাঙ্ক্ষী সেনা অফিসার। ‘সবাই বলতো, আমার বাবা দেখতে ছিলেন দারুণ! ঋজু দীর্ঘ দেহ, কালো চুল, নীল চোখ। আর দারুণ উদ্যমী একজন মানুষ। প্রচুর হাসতেন।’- স্টাফেনবার্গের সন্তান বার্থহোল্ড শেন্ক গার্ফ ভন স্টাফেনবার্গের কথা এসব। তার বয়স এখন ৮০ বছর প্রায়।
১৯৪৩ সালে তিউনিশিয়ায় যুদ্ধ করার সময়ে মারাত্মকভাবে আহত হন স্টাফেনবার্গ। এসময় তিনি তার ডান চোখ, ডান হাত হারান, আরও হারান বাঁ হাতের দুইটি আঙ্গুল। স্টাফেনবার্গের সন্তান বার্থহোল্ড আরও বলেন, ‘আমরা সবাই জানি সেসময় যুদ্ধে আহত হলে কী অবস্থা হতো। চোখ আর হাত হারালেও তিনি তার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যে বেঁচে ছিলেন সেটাই আমাদের জন্য বেশি সুখকর ছিল।’
রাজনৈতিক জীবনে স্টাফেনবার্গ ছিলেন ঘোরতর জাতীয়তাবাদী এবং রক্ষণশীল। যুদ্ধ শুরুর পূর্বে তিনি নাৎসি নীতিকে সমর্থন দেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, যখন দেখলেন ঐ নীতির কারণে পূর্বাঞ্চলে জার্মান বাহিনী হেরে যাচ্ছে এবং চূড়ান্ত পরাজয় অত্যাসন্ন, তখন তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। এবং হিটলারের রণকৌশল এবং ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করলেন। কিন্তু হিটলার ছিলেন অন্যরকম লোক। তাকে টলানো স্টাফেনবার্গের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
দ্রুত আরোগ্য লাভের পর স্টাফেনবার্গ জেনারেল হেনিং ভন ত্রেসকোর নেতৃত্বাধীন একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। এই গ্রুপটি হিটলারকে হত্যা করে নাৎসি শাসনের অবসান চাইছিলেন। হিটলারকে হত্যা করার জন্য বেশ কয়েটি পদক্ষেপ নেয় ভিন্ন ভিন্ন কিছু গ্রুপ। পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হয়ে উঠছিল। সবারই সন্দেহ হচ্ছিল যে, হিটলারকে হত্যা করার পেছনে খোদ গেস্টাপোরাই কলকাঠি নাড়ছে।
কিন্তু ১৯৪৪ সালে হঠাৎ করেই, স্টাফেনবার্গ জার্মান রিপ্লেসমেন্ট আর্মির চীফ অব স্টাফ পদে উন্নীত হন। আর এই পদের বলে তিনি হিটলারের কাছাকাছি যেতে পারলেন। এবং তাকে হত্যা করার সুযোগ তার খুব কাছে চলে এলো। প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে হিটলারকে হত্যার পরিকল্পনা এগিয়ে চলছিল।
পরিকল্পনা হলো- স্টাফেনবার্গ ওলফ’স লায়ারের নিরাপত্তা বলয় অতিক্রম করে, ব্রিফকেসে বোমা নিয়ে হিটলারের কাছাকাছি চলে যাবেন। এরপর হিটলারের আশেপাশে ব্রিফকেসটি রেখে দেয়ার পর, কোনো এক কারণ দেখিয়ে বের হয়ে আসবেন। এরপর ‘বুম!’ কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্টাফেনবার্গ তার চীফ অব স্টাফের ক্ষমতাবলে চলে যাবেন বার্লিনে, ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে।
এই পরিকল্পনার সাফল্য সম্পর্কে তারা নিশ্চিত ছিলেন না। কিন্তু ত্রেসকো বলছিলেন, ‘হিটলারকে অবশ্যই আক্রমণ করতে হবে। কারণ, সবাইকে এটা বোঝাতে হবে, সকল জার্মানই তার অনুসারী নয়।’
_76326899_451543014(1) {focus_keyword} ‘আমার বাবা হিটলারকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন’ 76326899 4515430141
২০ জুলাই, ১৯৪৪। ওলফ’স লায়ারে পৌছুলেন স্টাফেনবার্গ। হিটলারের সঙ্গে সাক্ষাত হবে বেলা ১২টা ৩০ মিনিটে। তার আগে ব্রিফকেসে একটি বোমা ঢুকিয়ে নিলেন তিনি।
‘আমার মনে আছে, স্টাফেনবার্গের হাতে একটি বড় কালো ব্রিফকেস ছিল। কিন্তু সেই ব্রিফকেসটি আমি আর দেখিনি। তিনি সেটা টেবিলের নিচে রাখতে পেরেছেন কী না, তাও দেখতে পাইনি। এভাবে প্রায় পাঁচ থেকে দশ মিনিট কেটে গেল। আমি তাকে আর দেখতে পেলাম না। এরপর হঠাৎ করেই বিকটে শব্দে ফাটলো বোমা!’ বলছিলেন জেনারেল ওয়াল্টার ওয়ার্লিমন্ত।
বিস্ফারণে ওলফ’স লায়ার থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখে স্টাফেনবার্গ ভাবলেন, এতোদিনে হিটলারের রাজত্ব শেষ হলো। সোজা বার্লিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জানতেও পারলেন না, হিটলারের পাশে ব্রিফকেসটা রেখে চলে আসার পর, কেউ একজন সেটার জায়গা বদল করে রাখে। অবশ্য বোমাটিও অতটা শক্তিশালী ছিল না যে, হিটলারসহ আরও অনেককে হত্যা করবে। ঐ বিস্ফোরণে চারজন মানুষ মারা গেলেও, বেঁচে যান হিটলার।
স্মৃতি হাতড়ে জেনারেল ওয়ার্লিমন্ত বললেন, ‘বোমাটি যখন বিস্ফোরিত হলো, তখন একটি বড় ঝাড়বাতি আমার ওপরে এসে পড়ে। আমি সেটার নিচে চাপা পড়ে যাই। কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলাম, হিটলারকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। তার এক কাঁধ ধরে ছিলেন কেতেইল। আমি ভেবেছিলাম তিনি আহত হননি। প্রায় কয়েক ঘণ্টা পর নিশ্চিত হওয়া যায়, ফুয়েরারের কিছু হয়নি। তিনি বেঁচে আছেন এবং বার্লিনকে আলাদা করার কথা ভাবছেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই, স্টাফেনবার্গসহ অন্যান্য ষড়যন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে গুলি করে হত্যা করা হলো।’
‘ঘটনার ঠিক পরের দিন। আমার মা আমাকে আর আমার ভাইকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ‘বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন তোমাদের বাবা।’ আমি মাকে বললাম, বাবা এটা করলো কী করে? উত্তরে বললেন, ‘তিনি বিশ্বাস করতেন, জার্মানির ভালোর জন্য এটা তাকে করতেই হবে।’ ঘটনাটা আমার জন্য খুব কষ্টদায়ক ছিল। আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ স্কুল থেকে শুরু করে সবখানেই শুনে শুনে আমরা বুঝতে শিখেছিলাম, ফুয়েরার একজন চমৎকার মানুষ! আর সেই ফুয়েরারকেই কী না হত্যার চেষ্টা! আমাদের পরিবারের নাম পাল্টাতে হয়েছিল। কারণ হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী আমাদের খুঁজছিল।’
ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে কয়েক হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার এবং হত্যা করা হয়েছিল। গেস্টাপো পুলিশ রাভেন্সবার্ক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল বার্থহোল্ডের মাকে। যুদ্ধ শেষে, তাকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধের বহুদিন পর, বার্থহোল্ড পশ্চিম জার্মানির জেনারেল হন। এখনও তিনি তার জন্মশহরেই বাস করেন। বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে সঠিকভাবে হয়তো বলা যাবে না, হিটলারের মৃত্যু তখন কতটা জরুরী ছিল জার্মানির জন্য। তবে হিটলার যেমন জার্মান জাতির শক্ত মেরুদন্ড তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তেমনি অনেক মানুষকেও হত্যা করেছিলেন তিনি। সময়ের প্রয়োজনে হিটলারের মৃত্যু হয়ত অনিবার্য ছিল।