মো. মাহমুদুল হাসান, ইউরোপ থেকে ফিরে :: ইউরোপের সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে নিতে কিছুটা যখন ‘ক্লান্ত’, তখনই পৃথিবীর স্বর্গ সুইজারল্যান্ডে যাবার সময় এলো। টার্গেট, জেনেভা থেকে রোম হয়ে ফিরবো জঞ্জালময় ঢাকায়। জলবায়ু সম্মেলনে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশোতে বেশ ব্যস্ত সময় কেটেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সময়ের ব্যবধানে পাল্লা দিয়ে নিউজ পাঠানো, আবার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গিয়ে শাশ্বত বাঙালির খাবার তৈরির চেষ্টা— যদিও ডাল-ভাতই ছিলো খাবারের প্রধান উপাদান।
এভাবে সপ্তাহ দুয়েক কাটিয়ে, মাঝে মাঝে ওয়ারশো থেকে আশপাশের দেশের রাজধানীগুলো ঘুরে ফেললাম। ঠিক আশপাশ বলা যাবে না, দূরত্ব প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ৫শ কিলোমিটারের বেশি। যাওয়া-আসায় হাজার দেড়েকে দাঁড়ায়। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে ওয়ারশোর দূরত্ব ৬৮৭ কিলোমিটার, জার্মানির বার্লিন থেকে ওয়ারশো ৫৭১। তবে তারুণ্যের কাছে দূরত্ব বাধা নয়, তা-ই প্রমাণ করে ছাড়লাম আমরা। পোল্যান্ড থেকে প্রতিবেশী বড় বড় দেশে গিয়ে ফিরে ফিরে আসছিলাম।
তবে সম্মেলন শেষ করে মাত্র আড়াই ঘণ্টার দূরত্বে রায়ান এয়ারের ফ্লাইটে চড়ে বসলাম প্যারিসের উদ্দেশে। সেখানে আছেন ঠিক কাছের মানুষ বলতে যাকে বোঝায় তিনি, যিনি বড় হয়েও সহজে সমসাময়িক হয়ে যান, বন্ধু হতে পারেন নিমিষে, যিনি একটি ধর্মের পদবী ব্যবহার করেও ধর্মের ওপরে যেতে পেরেছেন, সেই দাদাÑ ইঞ্জিনিয়ার কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া। প্যারিসের পন্টিন এলাকায় সপরিবারে বসবাস তাঁর। মজার বিষয়, সাংবাদিকতার সুবাদে কল্যাণ দা’র সঙ্গে বছর তিনেক আগে ঘনিষ্ঠতা হয় মূলত ভার্চুয়াল জগতেই।
এরপর ২০১২ সালে একবার শেনজেন ভিসা পেয়েও ইউরোপে যাওয়া হলো না। তবে ২০১৩ সালের নভেম্বরের সুযোগটা মিস করতে চাই নি। একবার প্যারিসে গিয়ে কল্যাণ দা’র সঙ্গে দেখা না করাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়বে বলে মনে হচ্ছিল। কল্যাণ দা নিজের এলাকার মানুষ, এমনটা জানার পর সঙ্গী হলেন একাত্তর টিভি’র সিনিয়র সাংবাদিক আজাদ তালুকদার।
সকাল সকাল অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়লাম আমরা দুজন। ওয়ারশো শহরের এদিকটায় ১০-১২ দিনের মধ্যে একবারও আসা হয় নি। মডলিন এয়ারপোর্টটা ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোই শহরের বেশ খানিকটা বাইরে। প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে। কিছুটা ট্রেনে, কিছুটা বাসে গিয়ে বিমান ধরলাম। প্যারিসে আমাদের রিসিভ করার অপেক্ষা করছেন কল্যাণ দা। বিমান থেকে নেমে আবার বাস ধরতে হলো। কারণ এবারও এয়ারপোর্ট শহর থেকে বাইরে। বিকেল গড়িয়ে এলো। দুজনের সঙ্গে থাকা লাইকা মোবাইলের সিম কাজ করছিল না। দাদাও পাচ্ছেন না আমাদের। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না রিচার্জ করার সুযোগও। শেষতক ফিলিপিনো এক মহিলা এগিয়ে এসে সাহায্য করলেন আমাদের। নাটকীয় অনেক ঘটনা শেষে পৌঁছালাম কল্যাণ দা’র ছোট্ট কিন্তু ছিমছাম বাসায়। সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন বৌদিও। সঙ্গে দাদার তিন সন্তান মমি, প্রমি আর প্রজয়। তাদের আন্তরিকতাও বাবা-মায়ের মতোই। আমরা যেন তাদের পরিবারেরই কেউ। প্রত্যেকেরই রয়েছে বলার মতো অনেক গুণ। ছোট্ট প্রজয় অনর্গল ফরাসি বলে। আঁকাআঁকি আর নাচ-গানেও মমি-প্রমির রয়েছে বিশেষ নাম। আর বৌদির কথা বলতে গেলে এ লেখার এখানেই ইতি টানতে হবে। মনে পড়ে, দিনভর অর্ধাহার আর ভ্রমণক্লান্তির পর বৌদি’র হাতের রান্না যেন সত্যিই ছিলো স্বর্গীয় প্রসাদতুল্য।
দুটো দিন প্যারিসে থেকে ফিরে যেতে হবে পূর্বনির্ধারিত ভ্রমণসূচির দিকে। প্যারিসে মূলত ঘুরার দিন পাওয়া গেলো একটা। ভ্রমণগাইড যথারীতি কল্যাণ দা। বয়স যা-ই হোক তাঁর তারুণ্য আর রসিকতার পরিধি সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করলো। আমাদের নিয়ে একে একে ছুটে চললেন প্যারিসে থাকা বিশ্বখ্যাত স্থাপনাগুলোর দিকে। লুভর মিউজিয়াম, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির সেই মোনালিসার রূপ আর আইফেল টাওয়ারের উচ্চতা আমাদের মনকে সত্যিই নিয়ে গেল নতুন এক উচ্চতায়। তিনজন দিনভর ঘুরলাম, বাইরে খেলাম। সন্ধ্যায় দাদা আমাদের নিয়ে গেলেন অ্যালকোহলের বিশাল দোকানে। আমাদের কিনে দেবেন কিন্তু নিজে পান করবেন না, ঠিক বৌদির ভয়ে কি-না জানি না! অবশ্য শেষতক কেউই আর সেদিকে পা বাড়ালাম না। পন্টিনে ফিরে দেখি আজও বৌদির খাবার টেবিল নানা আয়োজনে সাজানো। চট্টগ্রামের খাবারও রয়েছে তালিকায়। পেটপুরে খেয়ে আড্ডা চললো রীতিমতো গভীর রাত অবধি। কিন্তু সকালে জেনেভার উদ্দেশে আমাদের ট্রেন ধরতে চাইলে উঠতে হবে ৫টার মধ্যে। ঘুমাতে গেলাম তিনটায়!
দাদা আমাদের নিয়ে গেলেন রেলস্টেশনে। অভিভাবকের মতো আমাদের সকালে ডেকে তুললেন, লাগেজ টেনে নিলেন, কিন্তু যখন ট্রেন ছেড়ে দিলো দেখলাম দাদা চোখ মুছছেন। বুঝলাম তিনি পরিবারের কাউকে যেন প্রবাসে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমি আর আজাদ ভাইও একই আবেগ আক্রান্ত হলাম। ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাদা আবার ফোন করলেন। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে কথা হলো আমাদের। এমন একজন বন্ধু, এমন একজন বড়ভাইয়ের ভালোবাসা নিয়ে আমাদের ট্রেন এগিয়ে চলছে ঘণ্টায় ১৬১ কিলোমিটার বেগে। প্যারিস থেকে জেনেভার দূরত্ব ৫৩৭ কিলোমিটার। পৌঁছুতে লাগবে কাটায় কাটায় তিন ঘণ্টা ৩১ মিনিট! ট্রেন চলছে। আমি ভাবছি ঢাকা-চট্টগ্রামের ট্রেন-দূরত্বের কথা। রেলদূরত্বে মাত্র ২৪৩ কিলোমিটার। কিন্তু কত ঘণ্টা লাগে? ইউরোপের পথ হলে মাত্র দেড়ঘণ্টা! কপাল খারাপ! ১৫ ঘণ্টাও লাগে আমাদের!
যা-ই হোক, সকাল ১১টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম জেনেভা। ট্রেন থেকে নেমেই পড়লাম ভাষা সমস্যায়, সারা ইউরোপ জুড়েই যেমনটা হচ্ছিল। আমরা বলি জেনেভা, ওরা বলে গেনেভা। যা-ই হোক, জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তরের সামনে গিয়ে দিনভর ছবির পোজ চললো! ইচ্ছে ছিল জেনেভা থেকে সোজা চলে যাবো ইতালির রোমে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ বেলজিয়ামে সাবেকমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ভাই মোরশেদ মাহমুদ সেখানে যাবার বায়না ধরেছেন। টিকিট করে রেখেছেন। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম। ব্রাসেলস গিয়ে আবার রোমে ফিরে ঢাকার উদ্দেশে বিমান ধরার বিষয়টি রিস্কের মধ্যে পড়ে।
অন্যদিকে জেনেভা থেকেও সরাসরি ভালো কোনো বাস-ট্রেন আমাদের পছন্দসই সময়ে নেই। সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে গেলে সবই মিলবে। সেখানে আছেন পরিবেশমন্ত্রীর পার্সোন্যাল অফিসার সারোয়ার ভাই। তিনি উঠেছেন আতিক ভাইয়ের বাসায়। ট্রেনে ঘণ্টা দেড়েকের দূরত্ব। আতিক ভাই আর নজরুল ভাই এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। তাদের দুজনই সপরিবারে সেখানে থাকেন। নজরুল ভাইয়ের সুইজারল্যান্ড জীবন প্রায় ২২ বছরের। আতিক ভাই আছেন বছর ছয়েক। বার্ন শহরের ডিপ্লোম্যাটিক এলাকায়ই থাকেন তিনি। আতিক ভাইয়ের তিন বাচ্চা। ভাবিকে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের নিয়ে। তবু খাবার-দাবারের আয়োজন থেকে একচুল বিরত হন নি। এবার ভাত নয়, বিরিয়ানি খাওয়ালেন তিনি। স্বাদ অপূর্ব!
নজরুলের ভাইয়ের বাসায় গিয়ে যত খাবার খেলাম তার সবই বাংলাদেশ থেকে নেওয়া! ইলিশ মাছের কড়কড়া ভাজা চাকটা পাতে তুলে দিয়ে বললেন, আমি নিজে বাংলাদেশ থেকে এনেছি। যখন কিনেছি, তখন মাছটা লাফাচ্ছিল। এতোদূর দেশে বসে স্বাদের দেশি ইলিশ খেয়ে সত্যিই অন্যরকম লাগছিল। কারণ বাঙালি পরিবার ছাড়া খুবই আমরা মাছ-ভাত খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম। আতিক ভাইও আমাদের নিয়ে গেলেন ‘পেঁয়াজের মেলা’য়। নিয়ে গেলেন সুইস ব্যাংকের সামনে। গেলাম আইনস্টাইন যেখানে থাকতেন সেখানে। এখন জাদুঘর সেখানে। আইনস্টাইটের হাতের লেখা ছুঁয়ে দেখলাম। রোমাঞ্চিত হলাম।
বিদায় নিতে হবে বার্ন থেকে। গন্তব্য রোম। ১৮৭ কিলোমিটার বেগে যখন ট্রেন ছুটে চললো তখনই আজাদ ভাইয়ের ফোনে কল এলো। রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটার রেজাউল করিম। থাকেন জেনেভায়। ইতালির পাসপোর্টধারী। নিজের বাড়িও আছে সেখানে। শুনে আমরা আশ্বস্ত হলাম, সেখানেও একজন অভিভাবক পাওয়া গেল। কিন্তু তিনি তো তখনও জেনেভায়! ফোনে রেজাউল ভাই জানালেন, ভয় নেই। আমি এখনই ছুটছি স্টেশনে। আপনাদের সঙ্গে রাতে দেখা হবে। আমরা রোমের টার্মিনিতে নামলাম রাত সোয়া ৮টায়। কিন্তু ফোন নিয়ে এবারও প্যারিসের মতোই অবস্থা। রেজা ভাইকে রিচ করা যাচ্ছিল না। আমরা উঠেছি স্টেশনের পাশের একটি হোটেলে।
ময়মনসিংহের ভুট্টো ভাই সেটি চালান। রাত তিনটা পর্যন্ত রেজাউল ভাইয়ের কোনো খবর না পেয়ে তার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। সকাল ৮টায়ও আমরা গভীর ঘুমে। হোটেলের দরজায় হঠাৎ নক। দরজা খুলে দেখি, মাথায় কালো হ্যাট, গায়ে কালো ওভারকোট, পায়ে গামবুট। চেহারা ইউরোপিয়ানদের কাছাকাছি। কালো অফিসিয়াল ব্যাগটা নিচে রেখে দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঘুমের ঘোরে কিছুটা ভয়ও লাগছিলো। কে এই আগন্তুক? ‘বদ্দা ক্যান্ আছন?’ বলতেই বুঝতে বাকি রইলো না ইনিই সরফভাটার রেজাউল করিম। মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলার পরই তার দর্শনে নিজেকে একত্রিত করলাম।
তিনি বললেন, আমি জাতিসংঘের পাশে থাকি। আমি পুরো বিশ্বের। আমি সবার। এসময় তিনি জানালেন, তার সঙ্গে স্থানীয়ভাবে যে ‘বিয়ে বিয়ে খেলা’র ঘটনা ঘটেছে তার করুণ বিবরণ। একসঙ্গে নাস্তা করলাম। কিন্তু শত শত মাইল দূর থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেও হঠাৎ কি যেন মনে হয় তার! ঘণ্টাখানেক থেকেই আবার জেনেভার উদ্দেশে পা বাড়ান তিনি। আমরা তাকে বিদায় জানিয়ে সূত্র মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কোনো হিসেবেই মিলছিল না। কেন তিনি এলেন আর কেনই বা চলে গেলেন…