মো. মাহমুদুল হাসান, নয়াদিল্লি থেকে :: দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রামের অবস্থা বেশ খারাপ। এশিয়ার ছোট বড় ৫০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। চট্টগ্রামের অবস্থান প্রথম ৭টির মধ্যে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথম স্থানে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। তৃতীয় অবস্থানে কলকাতা। আয়তনের তুলনায় বেশি মাত্রায় ছোট গাড়ি চলাচল বৃদ্ধিই এই দূষণের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। নয়াদিল্লিতে গতকাল বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া ‘কনক্লেভ অব চেঞ্জমেকার্স ফর ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেন্যাবল মবিলিটি’ শীর্ষক এক সেমিনারে এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
নয়াদিল্লির লোধী রোডের হ্যাবিট্যাট সেন্টারে দুদিনব্যাপী ওই সেমিনারের আয়োজন করে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (সিএসই)। এতে দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সেক্টরের শতাধিক প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। সেমিনারে গতকাল ৬টি সেশনে বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ভারত সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, চিকিৎসক, পরিবেশবিদসহ মিডিয়াকর্মীরা। এতে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের প্রায় ২৫ জন সাংবাদিক অংশ নেন। সেমিনারে বক্তারা বলেন, বায়ুদূষণের ফলে মানুষের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। ছড়াচ্ছে নানা রোগব্যাধি। হচ্ছে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ অসুখও। বায়ুদূষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে সাইক্লিংসহ বেশি বেশি হাঁটার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ এশিয়ার জনস্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব শীর্ষক এক প্রবন্ধে কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী মানস রঞ্জন রায় বলেন, বায়ুদূষণের ফলে অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট, হাইপারটেনশন এমনকি ডায়াবেটিসসহ লিভার–কিডনির জটিল সব রোগ হচ্ছে। এসব রোগ থেকে বাঁচতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সেমিনারে সিএসইর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি) অনুমিতা রায়চৌধুরী বলেন, দূষণমুক্ত নির্মল বায়ু নিশ্চিত করতে গত ১৫ বছর ধরে আমরা ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা মনে করছি, ভারতে বায়ুদূষণই ‘মেজর কিলার্স’। এখানে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে বড় শহরগুলোর তুলনায় ছোট শহরগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ বড় শহরগুলো ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে নানা ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কিন্তু ছোট শহরগুলোতে তা তেমন একটা হয় না। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ছোট শহরের সংখ্যাই বেশি।
তিনি বলেন, কার্বন নিঃসরণের দিক দিয়ে সাইকেল বা রিকশার মাত্রা শূন্য। পৃথিবীর বড় বড় শহরে যেখানে সাইক্লিংয়ের দিকে ঝুঁকছে সেখানে ঢাকা ‘রিকশা’ থেকে বের হওয়ার জন্য মরিয়া। রিকশা জিরো এমিশন হওয়া সত্ত্বেও তা উৎখাতের চিন্তার বিষয়টি বেশ উদ্বেগজনক। কারণ বায়ুদূষণের দিক দিয়ে ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। অনুমিতা বলেন, আধুনিকতা মানেই বেশি বেশি ছোট গাড়ি নয়। ট্যুরিজম মানেই প্রাইভেট কারকে প্রমোট করা নয়। চট্টগ্রামও ভারতের সিমলা, ন্যাইনিটাল, গ্যাংটক, সিকিম কিংবা দেরাদুনের মতো সুন্দর থাকতে পারে। এজন্য সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। বায়ু দূষণরোধে কেবল বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় শহরেই নয় ভারতের বিভিন্ন শহরে গাড়ি চলাচল সীমিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামেও তেমনি সাইকেলকে, হাঁটাকে, পরিবেশবান্ধব রিকশাকে প্রমোট করতে হবে। গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনতে হবে। একজন মানুষ দু–চার কিলোমিটার যাতায়তের জন্য একটি গাড়ি ব্যবহার করবেন এটি মোটেই পরিবেশ–উপযোগী নয়।
পরে ‘গুড নিউজ অ্যান্ড ব্যাড নিউজ’ নামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এটি বায়ু দূষণমুক্ত টেকসই চলাফেরার বিষয়ে নীতি–নির্ধারণে গৃহীত কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নভিত্তিক একটি বই। দুদিনব্যাপী ওই সেমিনার শেষ হবে আজ শুক্রবার। সমাপনী দিনে দুটি সেশনসহ দিল্লির পুরো পরিবহন ব্যবস্থার ওপর ফিল্ড ভিজিট থাকছে সেমিনারে অংশ নেওয়া দক্ষিণ এশিয়ার স্টেকহোল্ডারদের জন্য।
সিএসইর ডিরেক্টর জেনারেল সুনীতা নারায়ণ বায়ুদূষণের হাত থেকে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোকে রক্ষায় প্রাইভেট কারের জায়গায় বেশি বেশি পাবলিক বাস এবং সাইক্লিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা–চট্টগ্রামে আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। এই বিপুল লোকসংখ্যার চলাফেরার জন্য পাবলিক বাস–মেট্রোবাস, সাইকেলই সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত। ঢাকায় যেভাবে প্রাইভেট কার বাড়ছে তাতে বায়ুদূষণ আরও বাড়বে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে শহরগুলো। তিনি আরও বলেন, পাবলিক বাস সাশ্রয়ী। এতে জ্বালানি কম লাগে, বেশি মানুষ চড়তে পারে। প্রাইভেট কারের তুলনায় পাবলিক বাসের ব্যবহার যানজট কমাতেও ভূমিকা রাখতে পারে।