জলবায়ু পরিবর্তনকে অনেকেই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কর্মকাণ্ডই এর প্রধান চালিকাশক্তি। নগরায়ণের অরাজকতা, শিল্পবর্জ্য, কৃষিজমি ধ্বংস— সবকিছু মিলেই আমাদের পরিবেশকে করে তুলছে বিপন্ন।
চাক্তাই খালের ময়লা পানি কর্ণফুলীতে
চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী এখন দূষণের থাবায় মৃতপ্রায়। নগরীর চাক্তাই খাল দিয়ে প্রতিদিন টনকে টন বর্জ্য মিশছে কর্ণফুলীতে। প্লাস্টিক, পলিথিন, টক্সিক বর্জ্য নদীর পানিকে কালো করে তুলেছে।

একসময়ের প্রাণবন্ত কর্ণফুলী এখন দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানির ধারা, যা জলজ প্রাণীর জন্য মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
স্থানীয় জেলে সেলিম মিয়া বলেন, “আগে এই নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন মাছ প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা পেট চালাই কীভাবে?”
কর্ণফুলীর বেহাল দশা
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, কর্ণফুলী নদীতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক মানের অর্ধেকেরও নিচে নেমে গেছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, কর্ণফুলী যদি এভাবে দূষিত হতে থাকে, তাহলে চট্টগ্রামের পুরো ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়বে। নদী হারালে হারিয়ে যাবে মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি ও পরিবেশের ভারসাম্য।
সাতকানিয়ায় ফসলি জমি ধ্বংস করে ইটভাটা
অন্যদিকে সাতকানিয়ায় কৃষিজমি দখল করে গড়ে উঠছে অসংখ্য ইটভাটা। কৃষকরা বাধ্য হচ্ছেন জমি বিক্রি করতে, আবার কেউবা ভাড়ায় দিয়ে দিচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে উর্বর কৃষিজমি পরিণত হচ্ছে ধোঁয়া আর কালো ধুলায় আচ্ছন্ন মরুভূমিতে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮০০ কোটি ইট উৎপাদিত হয়, যার অন্তত ৬০ শতাংশই কৃষিজমি নষ্ট করে তৈরি ইটভাটা থেকে আসে। এই ধোঁয়া থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মাহমুদা সুলতানা বলেন, “আমরা নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি। খাল-নদী দূষণ, কৃষিজমি নষ্ট করা, অবাধ শিল্পায়ন— এসব মানুষের তৈরি কর্মকাণ্ডই জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও দ্রুততর করছে।”
সমাধান কোথায়?
জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এখন সমাধান খুঁজতে হবে। চলুন দেখে নিই কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
- নদী ও খাল রক্ষা আইন কার্যকর করতে হবে
- ইটভাটার বিকল্প পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে
- শিল্পবর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া পানিতে ফেলা যাবে না
- কৃষিজমি রক্ষায় কঠোর আইন ও সচেতনতা জরুরি
চাক্তাই খাল, কর্ণফুলী নদী আর সাতকানিয়ার কৃষিজমি— সবই মানুষের অবহেলা ও লোভের শিকার। মানুষ বুঝতে পারছে না, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আসলে নিজের অস্তিত্বই ধ্বংস করছে। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো ভবিষ্যতের সমস্যা নয়, এটি আজকের বাস্তবতা। আর এর মূল কারণ মানুষ নিজেই।
এখনই সময় সচেতনতার
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, তখনও বাংলাদেশে কৃষিজমি ধ্বংস করে ইটভাটা, খাল-নদী দখল ও বর্জ্য ফেলা অব্যাহত আছে। এর ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বাড়ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর পরিবেশ ধ্বংসের কারণে অর্থনীতিতে গড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। অথচ সঠিক নীতি ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এ ক্ষতি রোধ করা সম্ভব।
আহ্বান
মানুষকে বুঝতে হবে, প্রতিটি প্লাস্টিক নদীতে ফেললে তা মাছ, পানি, প্রকৃতি ও মানুষের জন্য মৃত্যুদণ্ড ডেকে আনে। কৃষিজমি ধ্বংস করে ইটভাটা চালানো মানে আগামী প্রজন্মকে খাদ্যসংকটে ঠেলে দেওয়া। নদী দূষণ বন্ধ করা মানে শুধু নদী বাঁচানো নয়, জীবিকা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বাঁচানো।
শেষকথা
আমরা যদি এখনই থামতে না পারি, তাহলে একদিন হয়তো কর্ণফুলী নদী শুধুই ইতিহাসের বইতে থাকবে, সাতকানিয়ার উর্বর জমি রূপ নেবে মরুভূমিতে, আর চাক্তাই খাল হারিয়ে যাবে দূষণের অতলে। প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানে নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা। তাই আজই সময় মানুষের তৈরি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর।

