
রূপালি গিটারের তারে যখন আঙুল রাখতেন, মনে হতো শহরের সব ট্রাফিক লাইট একসাথে সবুজ হয়ে গেছে—বাতাস স্বচ্ছ, রাতটা আরও নীল। আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন তেমনই একজন শিল্পী, যিনি শুধু গান করেননি—একটি প্রজন্মের হৃদস্পন্দনকে সুরে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশি রক হিস্টরিতে আইয়ুব বাচ্চু যেন একটি পূর্ণ অধ্যায়।
তিনি ছিলেন পারফর্মারদের পারফর্মার! গিটার শোল্ডার থেকে বুকের কাছে নামিয়ে, কখনও চোখ বন্ধ করে, কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে; আর সেই বিখ্যাত সিগনেচার—রূপালি স্ট্র্যাটোকাস্টার হাতে উঁচু করে ধরা। তার সাউন্ড ছিল এক অনন্য সমন্বয়। ব্লুজ-ভিত্তিক ফ্রেজিং, মেলোডিক সলো, ক্লিন ওভারড্রাইভে কাঁচের মতো ঝকঝকে টোন; আবার চাইলে হার্ড রকের ঘন ডিস্টরশনে আগুন হয়ে ওঠা। লাইভে ইমপ্রোভাইজড সলো, গানের ইন্ট্রোতে স্মরণীয় রিফ, এবং কোরাসে জনতার কণ্ঠ—এ তিনে তিনি তৈরি করতেন এক ‘কমিউনাল এক্সট্যাসি’, যা কেবল বড় ফেস্টিভ্যালে সম্ভব; আর সম্ভব লেজেন্ডদের পক্ষে।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্ম। সমুদ্রের শহরটার ভেজা বাতাসে, রেডিওর গান, পাড়ার তারুণ্যের বন্ধুত্ব—সব মিলিয়ে খুব ছোটবেলায়ই গিটারের প্রতি টান। লোকাল স্টেজ, ছোটখাটো শো, একসময় ব্যান্ড—এভাবেই প্রথম আলোর মুখ দেখল তার মঞ্চজীবন। তিনি আয়ত্ত করেছিলেন—ব্লুজ, রক, ব্যালাড; আর সেটিকে মিশিয়েছিলেন তার নিজের সুরের মন্ত্রে। খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের ভেতরের সেই তরঙ্গটা যেটিকে সুরে অনুবাদ করে কালক্রমে হয়ে যান লেজেন্ড।
আশির দশকে আইয়ুব বাচ্চু দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস-এ গিটারিস্ট হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দশক কাটান। মেলোডিক লিড, নিখুঁত বেন্ডিং, এবং স্টেজে নির্ভার উপস্থিতি—সে সময়েই তিনি বুঝিয়ে দেন, বাংলাদেশি ব্যান্ড সঙ্গীতে গিটারের ভাষা কতটা পরিণত হতে পারে।
নব্বইয়ের শুরুতে তিনি গঠন করেন নিজের ব্যান্ড—এল আর বি (লাভ রানস ব্লাইন্ড)। এই নামের মধ্যেই রয়েছে এক ধরনের রোমান্টিক দুঃসাহসিকতা, আর সাউন্ডে একযোগ কোমলতা ও আগুন।
আইয়ুব বাচ্চুর গানগুলোতে শহরটা কেমন যেন নিঃশ্বাস নেয়—ফুটপাথ, হেডলাইট, ছাদের আকাশ, বৃষ্টির শব্দ। প্রেম আছে, কিন্তু তা শুধু ব্যক্তিগত নয়; আছে সময়বোধ, আছে বদলে যাওয়ার তাগিদ, আছে বন্ধুত্বের নরম জলছাপ। তার অবিনশ্বর কয়েকটি গান এদেশের সমবেত স্মৃতির অংশ—চলো বদলে যাই, রূপালি গিটার, ফেরারী মন, ঘুম ভাঙা শহরে—শুধু গান নয়, এগুলো একেকটি মুহূর্ত, একেকটি ব্যক্তিগত আত্মকথা।
“চলো বদলে যাই” গানটি নব্বইয়ের ক্যাসেট-প্লেয়ার থেকে শুরু করে আজকের স্ট্রিমিং প্লেলিস্ট সব যুগে রিলেভেসন্ট। এ গানটি হলো বাংলার অবিরাম ‘র্যালি ক্রাই’। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে তিনি মেলোডিতে এমনভাবে ধরেছিলেন, যা একসাথে কোমল ও ক্ষুরধার। ‘‘ফেরারী মন,” “ঘুম ভাঙা শহরে” শহুরে একাকিত্ব, ছুটে চলা, থমকে যাওয়ার ভেতরও জীবনের ছায়া; এই কারণে গানগুলো মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত।
আইয়ুব বাচ্চু তার গিটারকে দিয়েছিলেন অদ্ভুত এক ব্যক্তিসত্তা। তার গিটার কখনো ছিলেন তার বন্ধু, কখনো তার সঙ্গী আবার কখনও প্রেয়সী। বাংলাদেশি রক হিস্টরিতে সেটার আলাদা এক আইকনোগ্রাফি তৈরি হয়েছে।
নব্বইয়ের দশক থেকে সহস্রাব্দের (মিলেনিয়াম) প্রথম দশক—বাংলাদেশে ব্যান্ড-সংগীতের সোনালি সময়। ক্যাসেট টেপ, মিক্সড অ্যালবাম, এফএম রেডিও, ক্যাম্পাস কনসার্ট—সব জুড়ে ছিল আইয়ুব বাচ্চুর উপস্থিতি। মিলেনিয়াল প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন এক ‘অ্যাক্সেসিবল হিরো’।
যিনি কনসার্টের ব্যাকস্টেজে দাঁড়িয়ে নতুন গিটারিস্টকে টোন সেট করতে সাহায্য করেন, রিহার্সাল স্পেসে গিয়ে পরামর্শ দেন, গান বানানোর গল্প শোনান। তার নিজস্ব স্টুডিও-স্পেস ও প্রোডাকশন ওয়ার্কফ্লো তরুণদের জন্য ছিল শেখার বড় জায়গা—কীভাবে আইডিয়া থেকে গান হয়, কীভাবে ব্যান্ড বানায়, কীভাবে স্টেজে দাঁড়াতে হয়।
নতুন প্রজন্মের বহু রকার স্বীকার করেছেন—তার গান শুনে, তাকে মঞ্চে দেখে, তাকে কাছ থেকে কথা বলতে দেখে তারা গিটার হাতে নিয়েছেন। এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেটের গিটার শপগুলোতে যে ‘ওভারড্রাইভ’ বা ‘স্ট্র্যাটের ক্লিন’ নিয়ে কিশোরদের গুঞ্জন—তার বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তিনি। তার গান ইউটিউব কভার কালচারের নিত্য আইটেম—ফোক-ফাঙ্ক থেকে মেটাল অ্যারেঞ্জমেন্টে—তিনি একইসাথে ‘কভার-ফ্রেন্ডলি’ এবং ‘অরিজিনালিটিকে প্ররোচিত’ করা এক কম্পোজার।
সুরের মানবিকতায় প্রতিটি শ্রোতাকে আবদ্ধ করে রাখার অসীম জাদু ছিলো তার কম্পোজিশনে। তার গানে টেকনিক আছে, কিন্তু কৌশল কখনই আবেগকে ঢেকে দেয় না। তিনি প্রমাণ করেছেন—ভাল গানের লিরিক, মেলোডি, অ্যারেঞ্জমেন্ট—তিনটির জোটই ‘অ্যান্থেম’ তৈরি হয়।
তিনি ব্যান্ডশিল্পকে ব্যক্তিগত নক্ষত্রত্বের বাইরে নিয়ে গেছেন—রিহার্সাল কালচার, গিগ ডিসিপ্লিন, সাউন্ডচেক, ট্যুরিং—সবকিছুর ওপর তার জোর তরুণদের কাছে স্কুলবই হয়ে আছে। ক্লাসিক রক-রিফারেন্স থেকে সমসাময়িক সাউন্ড পর্যন্ত—তিনি শেখার দরজা খোলা রেখেছিলেন। এই কৌতূহলই তাঁকে নব্বই থেকে এখন পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক রেখেছে।
সত্তরের দশকে আজম খানের “উচ্চারণ” দিয়ে রক জার্নির শুরু, আশিতে ব্যান্ডে জগতের শেকড় বিস্তৃত হয় আর নব্বইতে বিস্ফোরণ—এই দীর্ঘ ইতিহাসে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন সেতুবন্ধনকারী এক জ্যোতিষ্ক। তিনি রকের ”হার্ড-এজ” ধরে রেখেও বাংলা গানের ব্যালাড-সংবেদনকে পাশে বসিয়েছেন। যার সংমিশ্রণে এমন এক আধুনিকতার সৃষ্টি হয় যা বাঙালির কানে দেশজ আর হৃদয়ে বিশ্বজনীন।
স্ট্রিমিং যুগে প্লেলিস্টের স্ক্রল থামায় যে গানগুলো—তার অনেকগুলোতেই আছে আইয়ুব বাচ্চুর ছোঁয়া। কভার-সংস্কৃতি, ইউটিউব লাইভ, ইন্ডি-ফেস্ট—সবখানেই তার গান নতুন অ্যারেঞ্জমেন্টে জন্ম নিচ্ছে। প্রতিবাদী সমাবেশ, বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগ-ডে, রোড-ট্রিপ, আর কোনো এক ব্যালকনির রাত—চলো বদলে যাই বা রূপালি গিটারের কোনো রিফ এখনও মানুষের হাত কাঁপায়, গলা ভারী করে।
আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন গিটারিস্ট বা ভোকাল নন; তিনি সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো, আবার সময়কে এক ইঞ্চি এগিয়ে দেওয়ার সাহসের নাম। ২০১৮ সালের অক্টোবরে রংপুরের মঞ্চে তার শেষ শো—অভিনয়ের মতোই জীবনের পর্দা নামার আগে তিনি ছিলেন মঞ্চেই, নিজের মানুষদের মাঝখানে।
তার রূপালি গিটার আজ স্মৃতিস্তম্ভ, কিন্তু সুরগুলো এখনও বাতাসে কাজ করে—যে বাতাস আমাদের চলতে বলে, বদলাতে বলে, ভালোবাসতে বলে। এই দেশে যখনই কোনো তরুণ প্রথম গিটার কিনে বাসায় ফেরে, প্রথম যে রিফটা সে খুঁজে নেয়—সেটা প্রায়ই আইয়ুব বাচ্চুর। একজন শিল্পী এর চেয়ে বড় আর কী-ই বা লেগেসি রেখে যেতে পারেন?