ইসলামের সোনালি ইতিহাস রচনায় যেসব নারীর আত্মত্যাগ সবচেয়ে বেশি, তাঁদের একজন উম্মে উমারা নাসিবা বিনতে কাব (রা.)। তিনি একজন বিশিষ্ট আনসারি নারী সাহাবি। মদিনার প্রসিদ্ধ আনসার গোত্র ‘বনু নাজ্জারে’ তাঁর জন্ম। হিজরতপূর্ব মদিনায় যেসব নারী প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
মক্কার অদূরে পাহাড়ি উপত্যকায় ‘বাইয়াতে আকাবায়ে সানিয়া’ (আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত) নামে যে ঐতিহাসিক বাইয়াত সম্পন্ন হয়েছিল, তিনি তার প্রথম সারির সদস্য। ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়া নামক স্থানে যে ‘বাইয়াতে রিদওয়ান’ সম্পন্ন হয়েছিল, সেখানেও তাঁর অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কীর্তিময় সংগ্রামী এই মহীয়সী নারীর বীরত্বগাথা ইতিহাস নিয়ে আজকের এই লেখা।
ইসলামের ইতিহাসে ওহুদ যুদ্ধ ছিল বিরাট শিক্ষণীয়। সামান্য অবহেলায় যুদ্ধটি মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। চরম সংকটময় মুহূর্তে সাহাবিরা আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো উদাহরণ নেই। প্রায় ৭০ জনেরও বেশি সাহাবি শহীদ হন এ যুদ্ধে।
রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধে নারী সাহাবি নাসিবা বিনতে কাব (রা.)-এর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বামীসহ দুই পুত্র নিয়ে তিনি যুদ্ধের ময়দানে এসেছিলেন। তাঁর নিজ বর্ণনায় বিভীষিকাময় সেই যুদ্ধের ঘটনা এভাবে তুলে ধরেন, “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছাকাছি ছিলাম। মুসলমানদের হাত থেকে যখন যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল এবং নবীজির নিরাপত্তায় কয়েকজন সাহাবি তাঁকে বেষ্টন করে রাখলেন। তখন আমিও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হলাম এবং প্রাণপণ যুদ্ধ করতে আরম্ভ করলাম।
ইতিমধ্যেই কাফেরদের এক যোদ্ধা ইবনে কামিআ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দিকে চিৎকার করে এগিয়ে আসছিল এবং বলছিল, ‘মুহাম্মদকে দেখিয়ে দাও! সে যদি আজ বেঁচে যায় তাহলে আমার মুক্তি নেই।’ তার এই চিৎকার শুনে মুসআব ইবনে উমাইর এবং কয়েকজন সাহাবি তাকে প্রতিরোধ করতে অগ্রসর হলেন।
এটা দেখে আমিও দ্রুত অগ্রসর হলাম। আমি তার কাছাকাছি না যেতেই সে আমাকে দেখে দূর থেকে আমার কাঁধে তরবারির আঘাত করল। তরবারির আঘাতে কাঁধে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হলো। প্রচণ্ড ব্যথাও করছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি; বরং পাল্টা আক্রমণ করলাম। কিন্তু আল্লাহর দুশমন সেদিন বর্ম পরিহিত থাকায় আমার হাত থেকে বেঁচে যায়!” (তবাকাতে ইবনে সাদ : ৮/৪৪০-৪৪১)
সংগ্রামী এই নারী শুধু নবী (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায় ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না; বরং নবীজির মৃত্যুর পর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খেলাফতকালে মিথ্যা নবুয়তের দাবিদার মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল তাতেও তিনি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন, সাহাবিদের জীবনীর ওপর লিখিত কিতাব ‘উসদুল গাবাহতে’ সে যুদ্ধে তাঁর বীরত্বগাথার কথা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘মুসাইলামার বিরুদ্ধে যে সৈন্য বাহিনী প্রেরিত হয়েছিল তার অন্যতম যোদ্ধা ছিল নাসিবা (রা.)।
তিনি তাঁর পুত্র হাবিব বিন জায়েদকে নিয়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে মুসাইলামাতুল কাজ্জাব তার প্রিয় পুত্রকে শহীদ করে। এরপর নাসিবা (রা.) শপথ করেন যে মুসাইলামা জীবিত থাকতে তিনি গোসলের পানি স্পর্শ করবেন না। সে যুদ্ধে তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যুদ্ধ শেষে যখন ফিরে আসেন তখন তাঁর শরীরে তরবারি ও বর্শার বারোটি আঘাত ছিল। এমনকি এ যুদ্ধে তিনি একটি হাতও হারান!’ (উসদুল গাবাহ : ৫/৪৭৬)
সংগ্রামী এই মহীয়সী নারী মদিনায় ১৩ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকিতে তাঁর দাফন হয়। মহান আল্লাহ সংগ্রামী এই নারীর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করুন। ইসলামের পথে আমাদের নারীদেরও নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার তাওফিক দান করুন। লেখক : মুফতি ইবরাহিম সুলতান