ভিন্ন মতাদর্শকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক বছর ধরে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে তবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা বিশ্ব মারকাজ দিল্লি নিজাম উদ্দিন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভী ও মাওলানা জুবায়ের হোসেন ওলামা পরিষদের অনুসারীরা। বিভিন্ন সময়ে এ দুটি গ্রুপ পরস্পরকে দোষারোপ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে জড়িয়েছেন বাগবিতন্ডায়।
সহিংস অবস্থান নিয়ে সাথী ভাইদের রক্তে রঞ্জিত করেছেন একে অপরের হাত। মারাও গেছেন অনেকে। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একবার টঙ্গীতে হতে পারেনি বিশ্ব ইজতেমা (হজের পর মুসলিমদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশ)। ২০১৮ সালের নভেম্বরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তবলিগ জামাতের দুই গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করে ইজতেমা না করাসহ উভয়পক্ষকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত দেন।
এর পর বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া এতদিন অনেকটাই শান্ত ছিল মাওলানা সাদ ও জুবায়েরপন্থি অনুসারীরা। কিন্তু সম্প্রতি চাগিয়ে উঠেছে তাদের সেই পুরনো দ্বন্দ্ব। এ অবস্থায় ফের রক্তপাতের আশঙ্কা করছেন দুটি দলের অনুসারীরাই।
সর্বশেষ ঈদের পরের দিন ভোরে রাজধানীর ভাটারার ছোলমাইদ এলাকায় অবস্থিত ‘আল্-মাদ্রাসাতু মুঈনুল ইসলাম’ কওমি মাদ্রাসার ভেতরেই সংঘর্ষে জড়ান মাওলানা সাদ ও জুবায়েরপন্থিরা। এতে শিক্ষক-ছাত্রসহ আহত হয় অন্তত ৩৫ জন। তাদের কয়েকজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে মাওলানা জুবায়েরপন্থি ৬ জনের অবস্থা গুরুতর।
এ হামলার ঘটনার জন্য সাদপন্থি মাওলানা আবদুল্লাহ মনসুরসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও শতাধিক অচেনা ব্যক্তিকে দায়ী করে ভাটারা থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা। ঘটনার সবিস্তারে জানিয়ে খসড়া এজাহারও জমা দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু ওসি মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার পুলিশের গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তারা।
ডিসির দপ্তরে ‘মামলা গ্রহণের নির্দেশ প্রদানের আবেদন জানিয়ে আল্-মাদ্রাসাতু মুঈনুল ইসলাম কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আতাউল্লাহ’র স্বাক্ষরিত ওই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, গত ২ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে ‘আল্-মাদ্রাসাতু মুঈনুল ইসলাম’ মাদ্রাসায় অস্থানরত ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর সাদপন্থি সন্ত্রাসীরা সংঘবদ্ধ নৃশংস হামলা চালায়।
তাদের হামলায় ৬ জন গুরুতর রক্তাক্ত জখমসহ মোট ২৭ জন ওস্তাদ-ছাত্র আহত হন। এই হামলার অভিযোগ নিয়ে ভাটারা থানায় মামলা করতে গেলেও ওসি মোক্তারুজ্জামান মামলা নিতে অস্বীকার করে টালবাহানা করেন। এ অবস্থায় আমরা ছাত্র-শিক্ষকরা অসহায় ও আতঙ্কিত অবস্থায় দিন পার করছি।
থানায় জমা দেওয়া এজাহারের অনুলিপি ও মেডিক্যাল রিপোর্টের ফটোকপিও সরবরাহ করা হয় অভিযোগের কপির সঙ্গে। কিন্তু বুধবার পর্যন্ত থানা পুলিশ মামলা না নেওয়ায় গতকাল ভুক্তভোগীরা আদালতের দারস্থ হয়েছেন। দুপুরে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা ঢাকা মহানগর আদালতে অবস্থান করছিলেন বলে আমাদের সময়কে জানান ওই কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আতাউল্লাহ।
মাওলানা আতাউল্লাহ আরও বলেন, মাওলানা সাদপন্থিরা হামলা করে আহত করেছে আমাদের মাদ্রাসার এতগুলো ছাত্র-শিক্ষককে। ঘটনার পরপরই বিষয়টি ভাটারা থানার পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মামলা গ্রহণ করা হয়নি।
বিষয়টি জানিয়ে মামলা গ্রহণের নির্দেশ প্রদানের জন্য গুলশান বিভাগের ডিসির দপ্তরে আবেদনও করেছি। তার পরও মামলা দায়ের করতে পারিনি বিধায় আদালতে এসেছি। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মাদ্রাসাটির মাওলানা আতাউল্লাহ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল মামলার এজাহারে (খসড়া) উল্লিখিত এক নম্বর আসামি সাদপন্থি মাওলানা আবদুল্লাহ মনসুরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সেলফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এজাহারে বর্ণিত ৩ নম্বর আসামি মাওলানা আবদুর রাজ্জাক কাসেমী অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে আমাদের সময়কে বলেন, ঘটনার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
কারণ ঘটনার সময় আমি মাদ্রাসায় ছিলামই না। খবর পেয়ে ছাত্রদের দেখতে গিয়েছি মাত্র। তারপরও যদি মামলায় আমাকে আসামি করা হয় তা হবে হাস্যকর। মনে হচ্ছে, মাওলানা সাদ সাহেবের অনুসারীদের ফাঁসাতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের মামলায় আসামি করার চেষ্টা করছে একটি চক্র। যদি তা-ই হয় সাথীদের সঙ্গে আলোচনা করে আইনগতভাবেই বিষয়টির মোকাবিলা করা হবে।
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোক্তারুজ্জামান বলেন, মাদ্রাসাটি নিজেদের দাবি করে গত দুই মাস ধরে উভয় পক্ষই প্রতিষ্ঠানটিতে অবস্থান করছিলেন। ঈদের পরদিন মাদ্রাসায় একটু হট্টগোল হয়েছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষয়টি অবগত। এ পরিস্থিতিতে আমার বিরুদ্ধে কেউ যদি ডিসি স্যারের দপ্তরে অভিযোগ দেন সেখানে আমার কি-ই বা করার আছে। ওই মাদ্রাসায় নতুন করে যেন অপ্রীতিকর কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে সজাগ রয়েছি বলেও জানান তিনি।
মুহতামিম মাওলানা আতাউল্লাহ খসড়া এজাহারে উল্লেখ করেন, মাদ্রাসাটি দখলের উদ্দেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির কয়েক শিক্ষক ও মাওলানা সাদপন্থি বহিরাগতরা অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছিল। তারই অংশ হিসেবে গত ৭ জুন ভোররাতে এজাহারনামীয় আসামিদের নেতৃত্বে শতাধিক সাদপন্থি বাহিনী অতর্কিতে মাদ্রাসায় হামলা করে সিসিটিভি বন্ধ করে দেয়।
এর পর তারা মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আসবাবপত্র ভাঙচুর ছাড়াও মাদ্রাসার মুহতামিম, শিক্ষক-আলেম-ওলামাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। খবর পেয়ে ভাটারা থানা পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। সে দিনই এ ব্যাপারে ভাটারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (নম্বরÑ৩০৬) করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, গত ১ আগস্ট সন্ধ্যায় অভিযুক্ত সাদপন্থি নেতা মাওলানা আবদুল্লাহ মনসুরসহ ২০ থেকে ৩০ জন বহিরাগত সাদপন্থি মাদ্রাসার নিচতলায় মসজিদে অবস্থান নেয়। রাত ১১টার দিকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে শতাধিক সাদপন্থি জড়ো হতে থাকে মসজিদে।
এতে শিক্ষক ও ছাত্ররা আতঙ্কিত হয়ে পড়ায় মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ওস্তাদ ও নাজেমে তালিমাত মুফতি সলিমুল্লাহ ভাটারা থানার ওসিকে বিষয়টি জানান। কোনো অসুবিধা হবে না। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকেন এবং আমি দেখিতেছি মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন ওসি। কিন্তু রাত ১২টার দিকে বাইরে থেকে সাদপন্থি আরও অনেকেই মাদ্রাসা চত্বরে জড়ো হয়। ২ আগস্ট ফজরের নামাজের আগে আরও ২০ থেকে ৩০ জন সাদপন্থি মসজিদে ঢুকে।
নামাজের পরপরই বহিরাগতরা ছুরি, লোহার রড, ধারালো অস্ত্র নিয়ে দোতলায় উঠে মাদ্রাসার সিসিটিভির মনিটর-ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। এর পর দোতলায় অবস্থানরত নিরীহ ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। এতে মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা তালহা, গোলাম মুকতাদির, আরিফ, মঈনদ্দিন, নুরুল আলম, আলী আকবর, ইউসুফ ও মাওলানা ফয়সাল এবং মাদ্রাসার ছাত্র ওসমান, মাহফুজ, মোস্তফা, জহির, নাঈম, নরুল ইসলাম, শিহাব, বায়েজীদ, আবদুল আহাদ, রবিউল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, বাবুর্চি নুরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ, রশিদ আহমদসহ অনেকে আহত হয়। গুরুতর আহতদের ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত মুফতি মামুনুর রশীদকে নেওয়া হয় খিলগাঁওয়ে খিদমাহ হাসপাতালে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও উল্লেখ করা হয় এজাহারে।