নিজেই নিজের ছবি তোলাকেই সেলফি বলে এটিই মোটা দাগের সংজ্ঞা। অতিরিক্ত সেলফি তোলা কি মানসিক রোগ? আকাশ, পাহাড়-পর্বত, নদী, সাগর প্রকৃতির ছবি তোলা তো খুবই মননশীল কাজ এবং এটি একটি আর্ট এবং শিল্প। কিন্তু নিজে নিজের ছবি তোলা বা তুলতে থাকা এবং সামাজিক মিডিয়াতে দিতে থাকা এটি কী ধরনের শিল্প। এটা আসলে শিল্প বা মনন নয় এটি এক প্রকার রোগ। এই সেলফি তুলতে গিয়ে গত এক যুগে পৃথিবীতে বহু মানুষ দুর্ঘটনায় মারা গেছে, সেলফি তুলতে তুলতে এক সময় আত্মহত্যা করেছে কিন্তু ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে এটি যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছে মানুষের মধ্যে যেটি বিপজ্জনক সামাজিক বিশৃঙ্খলার রূপ নিচ্ছে। এবার হজে গিয়ে সেলফি তুলে পোস্ট করতে দেখা গেছে যা কল্পনা করা যায় না। পবিত্র স্থানে স্রষ্টার প্রাপ্তির আকাক্সক্ষায় যেখানে বিভোর থাকার কথা, সেখানে সেলফি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে পারছে কীভাবে। এবার এ দেশে পবিত্র ঈদুল আজহাতে পশু কুরবানির রক্ত এবং বডির ওপর দাঁড়িয়ে বসে সেলফি তুলে সামাজিক মিডিয়াতে পোস্ট করতে দেখা গেছে অনেককে। কতটা ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্জয়। নিকটাত্মীয় কবর দিতে দাফন করতে করতে নিজের ছবি তুলছে মরদেহের সঙ্গে, একেবারেই অস্বাভাবিক। আরো বহু বহু ঘটনা লম্বা করতে চাই না। এটা কী ধরনের অসুস্থতা বা কী ধরনের মানসিক বৈকল্য। মানুষ এভাবে নিজের ছবি তুলতে অস্থির হয়ে পড়ল কেন?
এ ব্যাপারে মনো গবেষকরা বলেন, অতিরিক্ত নিজের ছবি তোলার প্রবণতা এবং সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করার মানসিক সমস্যাটির নাম ‘সেলফিটিস’। এটি তিন প্রকার-
প্রথম স্তর : বর্ডার লাইন সেলফিটিস : যারা সারাদিনে ৩টি সেলফি তোলেন কিন্তু পোস্ট করেন না।
দ্বিতীয় স্তর : একিউড
সেলফিটিস : যারা অন্তত তিনটি সেলফি তুলে পোস্ট করেন।
ক্রনিক সেলফিটিস : যারা ইচ্ছেমতো সেলফি তোলেন এবং তিনটির বেশি ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। কোনো কোনো গবেষক বলেন, অতিরিক্ত সেলফি তোলার লক্ষণটি নার্সিসিজম লক্ষণের সঙ্গে ভালো মতো যায়। নার্সিসিজম হলো এক প্রকার মানসিক সমস্যা যখন কোনো ব্যক্তি নিজেকে অনেক সুন্দর আকর্ষণীয় চেহারার মনে করে এবং নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয় তখন সে নিজেকে বেশি করে দেখতে চায়। নিজের কথা ভাবতে চায়, নিজেকে সবার চেয়ে সুন্দর মনে হয়, লোকের প্রশংসা চায় ফলে নিজের মধ্যে তৈরি হয় আত্মপ্রেম, আত্মগর্ব, আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মমগ্নতা, ক্রমান্বয়ে একাকিত্ব, বিষণœতা, শেষে আত্মহত্যা করে বসতে পারে। অতিরিক্ত সেলফি তোলাকে নার্সিসিজম বলছেন বিজ্ঞানীরা কারণ লক্ষণ ওই রকমই। নিজের ছবি বারবার তুলে তা পোস্ট করা, লাইক আশা করা, প্রশংসা চাওয়া। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে রক্ষা না করে নিজের ছবি তার সঙ্গে তোলা। কোনো সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের ছবি তোলা এবং ওই অবস্থায় নিজের ছবি প্রচার করা। তবে সম্প্রতি মনোগবেষকরা সেলফির এই প্রবণতাকে- বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার (ইড়ফু উুংসড়ৎঢ়যরপ উরংড়ৎফবৎ) বা ইউউ বলছেন। যেমন প্রতিটি মানুষ আলাদা আলাদা। প্রতিটি মানুষের নাক, ঠোঁট, চোখ, থুতনি, কান, কপাল, গলা, ভিন্ন ভিন্ন আদলে তৈরি। তার মধ্যে কারো কানের লতি বড়, কারো ছোট, কারো নাক লম্বাটে, কারো খাটো, চোখ কারো টানা, কারো গোলাটে, যে যার মতো সুন্দর। কিন্তু বহু মানুষ আছে যারা নিজের অবয়বকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। যেমন কারো নাক হয়তো কিছুটা খাটো সে বিভিন্নভাবে সেলফি তুলে দেখে কোনটা ভালো লাগছে বা লম্বাটে লাগছে। সামনে থেকে, কাছ থেকে, দূর থেকে, বিভিন্ন কর্নার থেকে ছবি তুলে তুলে দেখতে থাকে কোনটা তার কাছে পছন্দ এবং সেটা সে ফেসবুকে বা সামাজিক মিডিয়ায় পোস্ট করে। যখন পছন্দ হয় না তখন শত শত ছবি তুলতে থাকে। মনের মতো হয় না তখন বিরক্ত হয়, এমন ঘটনা ঘটে বডি ডিসমরফিক ডিসঅর্ডার রোগীদের ক্ষেত্রে। এতে তারা ক্রমান্বয়ে বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেয়, অন্যের সঙ্গে মেলামেশা আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেয়। ঘরে থাকতেই পছন্দ করে। একাকিত্ব এবং ক্রমান্বয়ে বিষণœতা কখনো কখনো আত্মহত্যা। যেমন ব্রিটিশ এক তরুণ ডানি বাউম্যান একদিনে ২০০’র মতো সেলফি তুলেও যখন মনের মতো চেহারার ছবি তুলতে ব্যর্থ হন তখন আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন, কারণ তার বান্ধবীকে সুন্দর আকর্ষণীয় ছবি পাঠাতে চেয়েছিলেন কিন্তু মনের মতো একটাও হচ্ছিল না। উত্তর লন্ডনের মানসিক চিকিৎসক ডা. ডেভিট ভেলি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার কাছে যত রোগী আসে তার তিন ভাগের দুই ভাগ রোগীই থাকে যারা বডি ডিসমরফিক ডিসওর্ডারে আক্রান্ত, তারা মূলত সেলফিতে আক্রান্ত’। বিশ্বের জনপ্রিয় ও সঙ্গীত জগতের অসাধারণ প্রতিভাধর মাইকেল জ্যাকসন চেহারা ফর্সা করতে চাইলেন, চেষ্টাও করলেন, নাক খাড়া করতে চাইলেন, প্লাস্টিক সার্জারি করালেন, বহুবার রিপিয়ারিং করালেন তারপরও যেন মনের মতো হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মারাই গেলেন অথচ তার আগের কালো ধূসর রং এবং অরিজিনাল নাক কতই না ভালো ছিল।
আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে গত দশ বছরে মোবাইল ফোন বা ট্যাবের মাধ্যমে সেলফি তোলার সহজ চল শুরু হলে বর্তমানে তা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এখনই যদি তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি করা না হয় তবে দুর্ঘটনাসহ বহু অপ্রীতিকর বা সামাজিক বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং এই ধরনের চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন আত্মনিয়ন্ত্রণ।
সর্বশেষ কথা হলো আদর্শ সুস্থ মানুষ তাকেই বলে যিনি যেকোনো পরিস্থিতি বা পরিবেশে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তাই করা নয়। অস্থির বা বিক্ষিপ্ত মনকে স্বস্তির এবং ইতিবাচক আনন্দের পথে নিয়ে আসতে পারাটাই আদর্শ মানুষের কাজ। নিয়ন্ত্রণের সহজ সংজ্ঞা হলো- ‘ফেসবুকে বসতে ইচ্ছা হচ্ছে বসলাম না, ধূমপান করতে ইচ্ছা হচ্ছে করলাম না, কারো কথায় রেগে যেতে ইচ্ছা করছে রাগলাম না, বকতে ইচ্ছা করছে বকলাম না, খারাপ ছবি দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে দেখলাম না, সেলফি তুলতে ইচ্ছা হচ্ছে তুললাম না’। একজন মানুষ তত বড় যত বেশি তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সন্দেহ নেই কাজটি খুব কঠিন। কষ্ট করেই বড় হতে হয়, সফল হতে হয়। উপরে ওঠা কষ্ট নিচে নামা সহজ, কষ্ট করে আলো জ্বালাতে হয় নতুবা অন্ধকার। যার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই সে তো নিয়ন্ত্রণহীন বা ভারস্যম্যহীন যা একটি ব্যর্থতা, একটি অসুস্থতা। ক্যামেরা আছে বলেই নিজের ছবি ইচ্ছামতো তুলতে হবে এটা কি ধরনের ইচ্ছা। দর্শনীয় বা আকর্ষণীয় বা ঐতিহাসিক কোনো স্থানের ছবি বা বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানের সেলফি তোলা স্বাভাবিক। স্মৃতি ধরে রাখা উচিত এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটির একটি লিমিটেশন আছে, সৌজন্যবর্জিত বা বিরক্তিকর ভঙ্গিতে সবার সামনে সেলফি তোলা নিশ্চয় স্বাভাবিক নয়। সুতরাং সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা বোধ জাগ্রত করা দরকার। মানবিক গুণাবলি তথা ভেলুজ যদি সৃষ্টি করা না যায় তবে তো মানুষই হলাম না। মানবিক গুণাবলি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা নিজের মধ্যে জাগ্রত করতে পারলেই নতুন নতুন যত প্রযুক্তি আসুক এবং যতই প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি তৈরি হোক, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
লেখক : ড. মো. আলমাসুর রহমান