বার্তাবাংলা ডেস্ক :: ব-দ্বীপাঞ্চল বাংলাদেশের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠির মধ্যে রাখাইন অন্যতম। পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজ্য (বর্তমানে মিয়ানমার, হালের বার্মা) থেকে মূলত রাখাইনরা বাংলাদেশে এসে বসবাস শুরু করে। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বোদাপায়া আরাকান রাজা থামাদাকে পরাজিত করলে বিপুল সংখ্যক আরাকানী শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহন করে। বলা হয়, এদেশে এসে তারা রাখাইন নাম ধারণ করে। কিন্তু এর পক্ষে নৃতাত্ত্বিক কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে রাখান নামে বহু প্রাচীন এক গোষ্ঠির সন্ধান এই উপমাহদেশেই পাওয়া যায়। আজও তারা থাইল্যান্ডে বাস করছে।
বাংলাদেশে কক্সবাজার, মহেশখালী, মানিকছড়ি, টেকনাফ, চৌফলদন্ডী, হারবাং এবং বৃহত্তর পটুয়াখালীর কলাপাড়া, আমতলী, গলাচিপা, বরগুনা এলাকায় রাখাইনরা বাস করে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সামান্য সংখ্যক রাখাইন আদিবাসীর বসবাস। রাখাইনরা এদেশে ‘মগ’ নামে অভিহিত হলেও তারা নিজেদের মগ পরিচয় দিতে চান না।
রাখাইন পুরুষেরা সাধারনত লুঙ্গি, শার্ট পরিধান করে থাকে এবং কোন সামাজিক অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলে উপরোক্ত পোষাকের সঙ্গে জ্যাকেটের মত একটি প্রাংখেং চাপিয়ে নিজেদের গাম্ভীর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বয়স্করা তার সঙ্গে মাথায় পাগড়ি বেধে থাকে। নারীরা থামি (লুঙ্গি) ও আংগ্যি (ব্লাউজ) পরিধান করে এবং অনুষ্ঠানাদিতে উপরোক্ত পোশাকের সঙ্গে একটি ওড়না ব্যবহার করে। রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ায় অধিকাংশ উৎসবই বৌদ্ধধর্মের তাৎপযপূর্ণ দিনসমূহের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হয়।
রাখাইনদের সংস্কৃতিতে নৃত্যের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। কোন সম্মানী ব্যাক্তি অথবা গুনীজনের মৃত্যুতে ও শবদেহকে বহন করে নৃত্যের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয়। প্রদীপ হাতে রাখাইন তরুনীরা দলবদ্ধ হয়ে এ নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। আরাকান রাজ মাঙ বাগ্রীর আমল হতে এ নৃত্যের প্রচলন হয়। বাংলাদেশে রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় একশ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের সমাজে ধর্মের নামে বিচিত্র আচার –অনুষ্ঠান দেখা যায়। ধর্মের নামে আত্না-প্রেত্নাতা, অতিপ্রাকৃত শক্তি এবং অতিমানবে বিশ্বাসই হলো ধর্মের মূলমন্ত্র।
পূর্বপূরুষ, প্রকৃতি পূজা, বিশেষ বস্তুতে ভক্তি, স্বপ্ন ও নৈর্বেত্তিক শক্তিকে বিশ্বাস এবং তা নিয়ে নানা আড়ম্বর ও অনাড়ম্বর আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে রাখাইন আদিবাসীদের জীবনের অংশ। নানা পার্বন, নানা উৎসবে তারা তাদের এই ধর্মীয় আচার পালন করে থাকে। বৌদ্ধধর্মের পবিত্র দিনগুলি যেমন বৈশাখী বা বৌদ্ধপূর্নিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, ভাদ্র পূর্ণিমা, কার্তিকী পূর্ণিমা ও মাঘী পূর্ণিমায় নারী-পূরুষ, যুবক-যুবা , শিশু-বৃদ্ধ সকলেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর ধর্মবাণী শ্রবনের জন্য বৌদ্ধ মন্দিরে গমন করেন। অমাবস্যা ও অষ্টমীতে রাখাইনরা সমবেতভাবে বৌদ্ধমন্দিরে পুণ্যবর্ম সম্পাদন
বিশেষ করে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান শেষে পাড়ার প্রবীণেরা শুদ্ধ বস্ত্র পরিধাণ করে বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে অষ্টশীল ও ব্রহ্মচর্য পালন করেন। এ দুদিন তারা মন্দিরে দিনানিপাত করেন। বৌদ্ধধর্মে আষাঢ়ী পূর্ণিমার পর বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান। এর পরে একমাস তথা কার্তিক পূর্ণিমা পর্যন্ত কঠিন চীবর দান করা হয়। এই ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠানকে ‘ওয়া’ বলা হয়। রাখাইনদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এ পূর্ণিমায় মহামুনি বুদ্ধদেবের জন্ম।
রাখাইনদের পবিত্র স্থান বৌদ্ধ মন্দির বা ক্যাং। বৌদ্ধ মন্দিরে ঢোকার সময় জুতা খুলে খালি পায়ে ঢুকে বিনয়াবনত হয়ে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করতে হয়। বৌদ্ধ পূর্ণিমার দিনে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বৌদ্ধত্ব লাভ ও নির্বাণলাভ দিবস। এদিন মহাবোধি বৃক্ষতলা চন্দন ও বিভিন্ন প্রকার সুগন্ধিযুক্ত পানি ছিটিয়ে দেয়া হয়। কেননা ভগবান মহামতি গৌতমবুদ্ধ ঐ গাছতলায় ধ্যানস্থ থাকার পরই তিনি পুর্ণজ্ঞান বা বৌদ্ধত্ব প্রাপ্ত হন। এই দিবসে আরাকানের মত বাংলাদেশের রাখাইনরাও বৌদ্ধমন্দির আলোকসজ্জিত করে আতসবাজি ও ফানুস উড়িয়ে, ঘর-বাড়ি সাজিয়ে নানা রকম খাবার-দাবার তৈরি করে থাকে।
বাঙালি হিন্দুদের মতো রাখাইন সমাজে কোনো লোক মারা গেলে তাকে চিতায় পোড়ানো হয়। তবে কোন কোন রাখাইন মৃতদেহকে কবর দিয়ে থাকেন। কোন ব্যাক্তির মুত্যু হলে প্রথমে আত্নীয় পরিজন খবর দেয়া হয়। সবাই আসার পর মৃতকে সুগন্ধি সাবান ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে মুসলমানদের মতো স্নান করানো হয় ও চিতায় তোলার জন্য সাজানো হয়। চিতায় তোলার পর বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ঠাকুর (পুরোহিত) মৃত ব্যাক্তির মাথার পাগড়ি ধরে মন্ত্র পাঠ করে সুগন্ধি পানি ছিটায়। এ সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে সবচেয়ে নিকট আত্নীয় প্রথমে মুখাগ্নি করেন। পোড়ানো শেষ হলে সবাই নদীতে বা পুকুরের পানিতে স্নান করে যার যার বাড়ি যান।
চিতা নিভে গেলে পোড়ানো ছাই মাটি ছাপা দিয়ে ওখানে বাঁশ পুতে রাখা হয় এবং বাঁশের মাথায় সাদা কাপড়ের নিশান ওড়ানো হয়। সাতদিন বাদে তার নিকট আত্নীয়রা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ডেকে তার নামে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করেন এবং গ্রামের লোকদের নিমন্ত্রন করে খাওয়ান। রাখাইন সমাজে মরদেহ পোড়ানোর আগে রথে চড়িয়ে দুদল লোক দুদিকে থেকে দড়ি টানাটানি করেন। এদের এক দল স্বর্গপক্ষের এবং অন্য দল নরকপক্ষের বলে ধরে নেয়া হয়। সাধারনত অবস্থাসম্পন্ন কিংবা ধনীদের মরদেহই রথে চড়িয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানের অয়োজন করা হয়। তবে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ঠাকুরদের মরদেহ নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠানের রেওয়াজ রাখাইন সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত।
একজন সাধারন রাখাইনের মৃত্যু হলে তার আপনজন মৃতদেহ খুব বেশি হলে দুই-তিন দিন ঘরে রেখে তারপর তা শ্মশানে নিয়ে যান। কিন্তু ভিক্ষু বা ভিক্ষু সংঘের প্রধান বিহারাধ্যক্ষ প্রয়াত হলে মৃতদেহ ছয় থেকে এক বছর মমির ন্যায় অস্থায়ী বৌদ্ধ বিহারে বা ক্যাং এর ন্যায় শয়ন কক্ষে রেখে দায়ক-দায়িকাবৃন্দ বর্ণাঢ্য অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পালনের মাধ্যমে অগ্নিসংযোগ করেন। ৩দিনব্যাপী এই আনুষ্ঠানিকতা পালন পালন করা হয়, যা ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ব্রতাচার বলে অভিহিত। সাধারনত এসব অনুষ্ঠানে রাখাইন যুবক-যুবতীরা শবদেহসহ নৃত্য-মঞ্চ কাঁধে নিয়ে নৃত্য ও লোকসঙ্গীত পরিবেশন করে। দোলনা মঞ্চে শবদেহ দোল দিতে দিতে গান গায়। নৃত্য মঞ্চে এ বিভিন্ন ধরনের নৃত্য প্রদর্শন করাকে রাখাইন ভাষায় ‘কাতলাহ্ আকাহ্’ বলা হয়। এভাবে রাখাইনরা শবদেহকে নৃত্যের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানায়।
শেষ দিন সন্ধ্যায় চিতা মঞ্চে শবাধার স্থাপন করে শত শত আতশবাজি বারুদ বর্ষণে অগ্নিসংযোগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুর সৎকার করা হয় এবং শেষ রাতে আগুন নিভিয়ে তার চিতা ভস্ম সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে এই ভস্ম শ্মশানে পুঁতে তার উপর সমাধি নির্মান করা হয়। এই তিনদিনে হাজার হাজার রাখাইন নর-নারী, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর এক উৎসবমুখর অথচ ভাবগম্ভীর পরিবেশ অন্ত্যেষ্ট্রিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
করেন।