বার্তাবাংলা ডেস্ক :: মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফাঁসি শব্দটি আজও প্রচণ্ড ভীতির জন্ম দেয়। একটা সময় ছিল যখন অপরাধের জন্য অপরাধীর অঙ্গহানি কিংবা শিরশ্ছেদ করা হতো। নৃশংস সেই শিরশ্ছেদ ব্যবস্থাকে অনেকটা নমনীয় করার প্রক্রিয়া থেকে জন্ম নেয় ফাঁসির। ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের গাছে ফাঁসিতে সারি সারি ঝুলে থাকা ইন্ডিয়ানদের। সাদা চামড়ার একদল মানুষ ভূমি আর সম্পদ দখলের নামের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হাজারো মানুষকে সভ্যতা স্বীকৃত উপায়ে হত্যা করে। একসময় ফাঁসি দেয়া হতো প্রকাশ্যে। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে তত খুব নীরবে আর নিভৃতে আয়োজন হয়েছে এই ফাঁসির প্রক্রিয়া।
আজ আমরা তেমনই একজন মানুষকে নিয়ে আলোচনা করবো, যিনি একশ’র বেশি মানুষকে ফাঁসি দিয়েছেন। পেশা হিসেবে ‘ফাঁসি দেয়া’ সামাজিক দৃষ্টিকোনে ততটা শোভনীয় নয় বলে আমাদের আজকের ব্যক্তি তার নাম বলতে নারাজ। তবু নামের এই দুনিয়ায় তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার স্বার্থে একটি শব্দের ব্যবহার করতে হলো, যে শব্দটি নাম হয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। মনে করুন নামটি মাইকেল।
লম্বা, গালে ঘণ দাড়ি আর কালো চামড়ার মানুষ মাইকেল আর দশজন মানুষের মতোই মানুষ। তার চারপাশের মানুষ তাকে সেই মানুষ হিসেবেই জানে, যিনি কারাগারে চাকরি করেন। কিন্তু কারাগারে তিনি কি কাজ করেন তা কেউ স্পষ্ট করে জানেন না। কারণ মাইকেলের সত্যিকারের পেশার পরিচয় যদি সাধারণ জনতা জেনে যায় তাহলে সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ মানুষের মনে জল্লাদ আজও ঘৃণ্য এক ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত।
‘মানুষ যদি জানতে পারে আমার পেশা তাহলে তারা আমাকে ঘৃণা করবে। কেউই একজন জল্লাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। এই সমাজে বন্ধুহীন হয়ে বাস করা মুশকিল।’.. পাঠক, আমরা এমন এক ব্যবস্থায় বাস করছি যেখানে অবস্থান প্রেক্ষাপটে নির্ধারণ করা হয় অপরাধের তারতম্য। যেমন ধরুন, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করলে প্রচলিত আইন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিন্তু মর্কিন বাহিনী অথবা বিশ্বের নানান প্রান্তের ক্ষমতার চর্চাকারী গোষ্ঠি নির্বিচারে হাজারো মানুষকে হত্যা করছে, তাদের কিন্তু বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। অথচ মাইকেল সেই ব্যবস্থার অংশ হয়ে নিজে অপরাধীদের গলায় ফাঁসির দড়ি পরায় এবং সামাজিক মূল্যবোধের কারণে নিজের পেশা গোপন করে অদৃশ্য এক তথ্য গোপনের মতো অপরাধের জন্ম দেয়। এই অপরাধের কোনো হদিস রাখে না কেউ। কারণ এই অপরাধ চোখে দেয়া যায় না।
মাইকেলের বর্তমান বয়স ৫৫। এই বয়সেই তিনি শতাধিক মানুষের গলায় ফাঁসির দড়ি চড়িয়েছেন। অপরাধীকে (মানুষ) ব্যথামুক্ত মৃত্যু উপহার দেয়ার কাজটি সুচারুরূপে রপ্ত করে নিয়েছেন মাইকেল। গলার ঠিক কোথায় দড়ি পড়ালে সবচেয়ে কম কষ্টে মানুষটি মারা যাবে তা এখন খুব সহজেই করতে পারে মাইকেল। আর এই কাজ তিনি রপ্ত করেছেন প্রাচ্যের দেশ চীন থেকে।
‘যে ঘরে মানুষকে ফাঁসি দেয়া হয়, সেই ঘরে হেটে যাওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। একবার এক ক্ষুব্ধ কয়েদি আমাকে আঘাত করেছিল। তার হাতে যদি হাতকড়া পরানো না থাকতো, তাহলে হয়তো তিনি আমাকে মেরেই ফেলতেন।’
ফাঁসির আদেশ পাওয়া কয়েদিদের ফাঁসি দেয়ার আগে ভালো খাবার-দাবার দেয়া হয়। আর এই সময়টায় মাইকেল লোহার গরাদের অপর পাশ থেকে কয়েদির উদ্দেশ্যে ক্ষমা চেয়ে নেন। কোনো কোনো কয়েদি ক্ষুব্ধ আচরণ করেন, আবার কেউ শান্ত হয়ে থাকেন। কিন্তু মাইকেলের কাছে এই পুরো বিষয়টিই বেদনাদায়ক। কারণ যে মানুষকে তিনি ফাঁসির দড়ি পরাতে যাচ্ছেন, তার হয়তো স্ত্রী-পুত্র কিংবা বাবা-মা আছেন। সেই আত্মীয়-স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস তাই মাইকেলের কাছে দীর্ঘরাত্রির নিকশ অন্ধকারের মতো ভারি ঠেকে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে মানুষ হত্যার এই আয়োজনে আরও অনেকেই থাকেন। একজন ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট, উপাসনালয়ের নির্বাচিত ব্যক্তি এবং একজন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মানুষ থাকে। তবে মূল কাজটি করতে হয় মাইকেলকেই।
প্রতিবছর ১০ অক্টোবর ‘ফাঁসিতে মৃত্যু’র বিরোধীতা করে বিশেষ দিবস পালন করা হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই প্রকল্প চলার ফলে বিশ্বের ১৩৯টি দেশ এখন মৃত্যুদণ্ড থেকে ফিরে এসেছে। তবে এখনও অনেক দেশ আছে যারা মৃত্যুদণ্ড বিধান রেখেই আইনী রাষ্ট্র কায়েম করছে। মাইকেল আশা করে একদিন তার দেশ উগান্ডাতেও মৃত্যুদন্ড রহিত করা হবে। আর এই দণ্ড রহিত করা হলে মাইকেলকে হয়তো ভিন্ন পেশা অবলম্বন করতে হবে, কিন্তু তাতেও তিনি খুশি। কারণ তখন অন্তত তিনি তার বন্ধুদের তার সত্যিকারের পেশার কথা বলতে পারবেন।