বার্তাবাংলা ডেস্ক:: উত্তর জর্দানের এক হাসপাতালকক্ষে বসে, বিমর্ষ এক পিতা বলছিলেন তিার জীবনের স্মরণীয় এক দিনের কথা, যেদিন তার শিশুপুত্রটির হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটির নাম জিয়াদ। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিল সীমান্তবর্তী দিরায়, দাদার বাড়িতে। সেখানে এক অবিস্ফোরিত মর্টার পড়ে থাকতে দেখতে পায় সে। শিশুসুলভ কৌতূহলে হাতে নিতেই সশব্দে বিস্ফোরিত হয় সেটি। এরপর মুখে, ডান হাতে ও পায়ে মর্টারের শ্রাপনেল বিঁধে মুহূর্তে রক্তাক্ত হয়ে ওঠা জিয়াদের, মৃত্যুর সঙ্গে অসম লড়াই শুরু হয়।
পুত্রের বিবশ দেহ নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় ইতস্তত কাজ করতে থাকা মাঠপর্যায়ের অস্থায়ী হাসপাতালের শরণাপন্ন হলেন পিতা। জিয়াদকে দেখে তারা বললো, এখনই অস্ত্রোপচার করা প্রয়োজন, কিন্তু এখানে তা সম্ভব নয়। আরও এক অস্থায়ী হাসপাতালে গেলে, সেখানেও বলা হলো একই কথা, সঙ্গে যোগ করা হলো:
‘তুমি জর্দান সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে না, পারার কথা নয়। কিন্তু এদিকে আমরাও অস্ত্রোপচারে অক্ষম, এখানে যথেষ্ট যন্ত্রপাতি নেই।’
তৃতীয় অস্থায়ী হাসপাতালে নিতেই তারা প্রথমে জিয়াদের ক্ষতগুলো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল এবং সীমান্তে জরুরি বার্তা পাঠালো। অপরদিক থেকে সবুজ সংকেত আসতেই নিজ গাড়িতে সীমান্তের দিকে ছুটলো জিয়াদের বাবা, সঙ্গে মুমূর্ষু সন্তান।
সিরিয়ার ওই অঞ্চল থেকে জর্দান সীমান্ত ছিল মাত্র ১৫ কিলোমিটারের দূরত্বে। কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় নানা চেকপয়েন্ট আর ঘুরপথে বেড়ে তা গিয়ে ঠেকেছিল ৬০ কিলোমিটারে। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে যখন সীমান্তে পৌঁছুনো গেল, কিন্তু ততক্ষণে জিয়াদের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে।
সীমান্তে জর্দানের স্বেচ্ছাসেবী দলটি উপস্থিত ছিল, প্যারামেডিকেল প্রশিক্ষণ ছিল তাদের। ছেলেটার নাড়ি দেখে তারাও মনে করতে বাধ্য হলো, জিয়াদ মারা গেছে।
এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত, ‘মৃত’ ছেলেকে নিয়েই হাসপাতালে ছুটে গেলেন উন্মাদপ্রায় পিতা, সীমান্ত থেকে আরও তিন কিলোমিটার দূরে জর্দানের রামথা সরকারি হাসপাতাল। পিতার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না, যে কারণে সে হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরলস চেষ্টায় আবারও জীবন ফিরে পেল জিয়াদ। চিকিৎসকদের ওই দলটি মেডিসিন স্যানস ফ্রন্টিয়ার্স নামে একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিল।
তিন সপ্তাহের মধ্যে জিয়াদ উঠে বসলো এবং আরও একটি দাতব্য সংস্থার উপহার দেয়া হুইল চেয়ারে বসে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে শুরু করলো। জিয়াদ প্রাণে বেঁচে গেলেও, জীবনের করাল রূপের একটি চিহ্ন থেকে গেল জিয়াদের শরীরে। মর্টারের শ্রাপনেল সবচেয়ে বেশি ঢুকেছিল যে ডান বাহুতে, তা আর কোনদিন ব্যবহার করতে পারবে না সে।
৩৩ নম্বর বেডের রামথা হাসপাতালে এমন আরও অসংখ্য শিশু নাজুক মৃত্যুসঙ্কুল শারীরিক অবস্থা কাটিয়ে উঠে ক্রমেই সুস্থতা ফিরে পাচ্ছে, ছবি আঁকছে, আবারও তাদের দেশকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শিখছে। ভাবছে, একদিন নিশ্চয়ই রূপকথার শান্তিময় মাতৃভূমিতে আবার ফিরে যাবে তারা, যেখানে তাদের জন্যে অফুরান ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু থাকবে না।
