প্যারিস (ফ্রান্স) প্রতিনিধি :: বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ফ্রান্সে প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন। এর ফলে দূতাবাসের ওপর রয়েছে বেশ চাপ। কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়াও ভিসা, পাসপোর্ট প্রদান-নবায়নসহ বাংলাদেশ থেকে আনা বৈধ কাগজপত্র সত্যায়িত করা দূতাবাসের রুটিনওয়ার্ক। এর ফলে হাজার হাজার বাংলাদেশিকে কমবেশি দূতাবাসে ভিড় করতে হয়। কিন্তু দূতাবাসে গিয়ে দেখা যায়, সেবা গ্রহণকারীদের জন্য অভ্যর্থনা কক্ষে বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাই নেই। তিনটি সিটের নামমাত্র সোফাই সম্বল।
এর ফলে দূতাবাসে আগত লোকজনদের বাধ্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এমনকি মহিলাদেরও এই অবস্থার শিকার হতে হচ্ছে। সেবাগ্রহণকারীদের সুবিধার্থে একটি ইলেকট্রনিক সিরিয়াল টিকিট কাউন্টার মেশিন থাকলেও তার সুফল কোনোদিন পাননি বাংলাদেশিরা। এর ফলে বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকে। অন্যদিকে ‘অমুক সাহেব, তমুক সাহেব’-এর নাম বলে ভেতরে গিয়ে কাজ সারিয়ে নেন। এতে করে ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ প্রবাসীদের। এ বিষয়ে প্রবাসীদের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের।
অন্যদিকে কনস্যুলার সেবার বিপরীতে যে ফি নির্ধারণ করা আছে তাও পুরোনো। আনিসা আর আমিন নামের এক কর্মকর্তা বছরখানেক আগে বদলি হয়ে গেলেও তার স্বাক্ষরিত নোটিশটি এখনও ঝুলছে দূতাবাসে। ওই নোটিশে বাংলাদেশিদের কাগজপত্র সত্যায়ন করার ফি উল্লেখ খাকলেও বর্তমান ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়ালীউর রহমান কোনো বৈধ ডকুমেন্টও সত্যায়িত করেন না। তিনি শুধুমাত্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরিত ডকুমেন্ট সত্যায়িত করেন। অভিযোগ আছে, দূতাবাসের একটি দালাল চক্র ‘সত্যায়ন ব্যবসা’য় জড়িত। বিভিন্ন অঙ্কের ইউরো পেলে অবৈধ কাগজও বৈধ হয়ে যায়!
ফ্রান্স দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট তুলতে বা নবায়ন করতে হলে বাংলাদেশ থেকে ১৭ ডিজিটের জন্মনিবন্ধন সংখ্যাটি পাসপোর্টে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সেই জন্মনিবন্ধনটি সত্যায়ন করতে গেলে দূতাবাসের কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দেন, সেটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সত্যায়িত করিয়ে আনার পরই দূতাবাসের কর্মকর্তারা সত্যায়িত করবেন। এ বিষয়টি চরম ভোগান্তির বলে মনে করছেন ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। তাদের প্রশ্ন, যে কাগজের বিপরীতে একটি আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট মেলে সেই কাগজ সত্যায়িত করতে আবার বাংলাদেশে যেতে হবে? সেই কাগজ বাংলাদেশে পাঠাতে হবে? দূতাবাসের প্রথম শ্রেণীর একজন গেজেটেড কর্মকর্তা পারবেন না কেন? দূতাবাসে চাকরি করলে কি তাদের ক্ষমতা খর্ব হয়ে যায়? জন্মনিবন্ধন সনদটি বৈধ না হলে কীভাবে সরকার পাসপোর্ট দিলো? ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশিদের এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার যেন কেউ নেই।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত এম. শহীদুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে কী ধরনের নিয়ম রয়েছে তা আমি খতিয়ে দেখবো। অহেতুক কাউকে হয়রানি করা হলে দোষীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দূতাবাসের নানান অনিয়ম, অ্যবস্থাপনা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভোগান্তি শিকার হচ্ছেন হাজারো বাংলাদেশি। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সে বসবাসরত একজন বাংলাদেশি নিজের ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেন বার্তাবাংলা’র কাছে। তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধের বিপরীতে নিজের ছেলেমেয়েদের পাসপোর্ট হাতে পেয়েছি। কিন্তু বাচ্চাদের স্কুলের প্রয়োজনে এখন জন্মনিবন্ধন সত্যায়িত করাতে গিয়ে মহাভোগান্তির শিকার হচ্ছি। তিনদিন নিজের কাজ ফেলে, চাকরির ক্ষতি করে দূতাবাসে ধর্ণা দিয়েও সমাধান হয়নি। অ্যাম্বাসেডরকে বলেও কোনো সুবিচার এখন পর্যন্ত পাইনি। অবশ্য তিনি সুন্দর ব্যবহার করেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, ছোট্ট একটি বিষয়েও কেন অ্যাম্বাসেডরকে জড়াতে হবে?
ওই ভুক্তভোগী বার্তাবাংলা’কে জানান, রাষ্ট্রদূতের আশ্বাস পেয়ে তিনি ফার্স্ট সেক্রেটারি ওয়ালীউর রহমানের কাছে যান। কিন্তু একই কথা জানান ফার্স্ট সেক্রেটারি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি আর স্বাক্ষর ছাড়া তিনি সত্যায়িত করতে পারবেন না। এ সময় আগের কর্মকর্তা আনিসা আর আমিনের কথা উল্লেখ করা হলে ওয়ালীউর রহমান বলেন, আগের কর্মকর্তা অনিয়ম করেছেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে।
ফার্স্ট সেক্রেটারিকে যখন প্রশ্ন করা হয়, যে কাগজ আপনি সত্যায়িত করতে পারেন না সেই কাগজই আপনি ভ্যারিফাই করে দেওয়ার পর সরকার পাসপোর্ট দিয়েছে। তা কীভাবে সম্ভব হলো। এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
সরকারের একজন পদস্থ কর্মকর্তার এমন মর্জিমাফিক কথাবার্তার কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন ফ্রান্সে বসবাসরতরা। তাদের প্রশ্ন, এটা কি সত্যিই ওই কর্তার মর্জি নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রের মারপ্যাঁচ? আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মানবসৃষ্ট মারপ্যাঁচ কিংবা কর্মকর্তার মর্জির খেসারত আর কতদিন দিতে হবে ফ্রান্সপ্রবাসীদের?