বার্তাবাংলা ডেস্ক :: নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি ‘নষ্ট’ বলতে ভালবাসি। …নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত ‘নষ্ট হওয়া’। ‘নষ্ট’ না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকারের সুস্থ ও মেধাবী মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে।’
‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য’ তসলিমা নাসরিনের লেখা একটি বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত বই। সেই বইটির মুখবন্ধে এই কথাগুলি তিনি লিখেছিলেন। লিখেছিলেন – মানুষকে মানবতার আলোয় নতুন করে মনুষ্যত্বকে উপলব্ধি করার জন্য। লিখেছিলেন সেই আদিম পুরুষপ্রধান পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে লক্ষ্য করে। লিখেছিলেন একটি সুন্দর, সুস্থ সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, যে সমাজ পক্ষপাতদোষে দুষ্ট নয়। যে সমাজে নারীর মূল্য তার রূপ দিয়েই নির্ধারিত হবে না, নির্ধারিত হবে তার বিদ্যায়, গুণে, প্রেমে, উন্নতস্পর্দ্ধীমনে, দুঃসাহসিকতায়, সত্যনিষ্ঠায় আর সৃজনীশক্তির যথার্থমূল্যে।
‘এই নষ্ট সমাজ ওত পেতে আছে, ফাঁক পেলেই মেয়েদের ‘নষ্ট’ উপাধি দেবে। সমাজের নষ্টামি এতদূর বিস্তৃত যে, ইচ্ছে করলেই মেয়েরা তার থাবা থেকে গা বাঁচাতে পারে না।’ (‘নির্বাচিত কলাম’ পৃ ১৭) নিজের জীবনের শত শত ঘটনা বা দুর্ঘটনায়, এই সমাজের সম্পর্কে এইরূপ সত্য মন্তব্য করতে পেরেছিলেন তসলিমা। সমাজ তাঁকে নষ্ট করতে চেয়েছে, সমাজের মানুষ খুলে দিয়ে চেয়েছে তাঁর বুকের আচ্ছাদন, এমনকি অন্তর্বাস পর্যন্তও। ভালোবাসার নাম করে, প্রেমের নাম নিয়ে তাঁর যৌবনকে শুধু উপভোগ করতে চেয়েছে এই ‘নষ্ট’ সমাজের মানুষ। মধুলোভী মধুপবৃন্দ যেমন কমলগন্ধে উন্মত্ত হয়ে ছুটে যায় পদ্মবনে, বুকভরা পিপাসা নিয়ে, তেমনি তাঁর যৌবনবতী সুঠাম দেহের আকর্ষণেই বারবার তাঁর কাছে ছুটে এসেছে মহিষাসুরের দল। এবং বলা বাহুল্য যে, পরিণামে তারাই তসলিমাকে ‘নষ্ট মেয়ে’ বিশেষণে বিশেষিতা করতে কার্পণ্য দেখায় নি। কিন্তু তসলিমা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় জীবনের প্রতিটি পদে, যাতনার প্রতিটি মুহূর্তে, মিলনের রাতে বা বিরহের দুঃসহ দুপুরে, তাঁর জীবন দেবতাকে শুধু এই প্রার্থনাই জানিয়েছেন,
‘হে বিধাতা আমারে রেখো না বাক্যহীনা।
রক্তে মোর বাজে রুদ্রবীণা,
উত্তরিয়া জীবনের সর্বোন্নত মুহূর্তের পরে
জীবনের সর্বোত্তম বাণী যেন ঝরে,
কন্ঠ হতে-
নির্বারিত স্রোতে।’
(‘সবলা’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
(২) জন্ম ও শৈশব
তিনি জন্মেছিলেন ১৯৬২ সালের ২৫শে আগষ্ট, বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। আগামীদিনের মানুষ ২৫শে আগষ্ট দিনটিকে সাড়ম্বরে উদযাপন করবে। হতে পারে সেইদিন সুদূর, হয়তো কয়েক শতক। কয়েক শতক মানুষের জীবনে স্কেলে অনেক, কিন্তু অনন্তের কাছে! কিন্তু এই দিনটিকেও যথার্থ মর্যাদা আমাদের এই ‘নষ্ট সমাজকে’ একদিন দিতে হবে, নইলে পরিত্রান নেই, পরিত্রান নেই কলকাতার, কিংবা ভারতবর্ষের, যেখানে সামান্য একটু আশ্রয়ের খোঁজে বারবার ছুটে যান তসলিমা, কিন্তু ফিরতে হয় হতাশ হয়েই। কলকাতার রাস্তায়, আনাচে কানাচে আশ্রয় পায় কত কুকুর বেড়াল, কত হীনমনা অমানুষের দল, কিন্তু ‘সর্বধর্মসহিষ্ণুতার’ দেশ, ভারতবর্ষ, যার মাটিতে মাটিতে, ধূলিকণায়, বৃক্ষলতায়, কোকিলকুলকূজনে, নদীকল্লোলেও নাকি ধ্বনিত হয় শাস্ত্রবাক্য ‘অতিথি দেবো ভবঃ’, সেখানে আশ্রয়হীনা তসলিমা পান না সামান্য আশ্রয়টুকুও, কারণ – এই সমাজের চোখে তিনি ‘নষ্ট’।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পুরুষপ্রধান পরিবারে শৈশব ও কৈশোর কাটে তসলিমার। প্রতি ক্ষেত্রে ‘মেয়ে’ বলে তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নানা অতিরিক্ত নিয়মকানুন, যা তিনি তখনো বুঝে উঠতে পারেন নি বা আজও বুঝতে পারেন না, কেন একই পরিবারের ছেলে আর মেয়ের জন্য আলাদা নিয়ম। গাছের পাকা প্রথম ফলটি যেদিন তিনি পেলেন না, পেলেন তাঁর দাদা, তাঁকে বলা হল, ‘গাছের প্রথম ফল মেয়েদের দিতে নেই’। দূরন্ত কৈশোরে তাঁকে ফলবতী বৃক্ষে আরোহণ করতে দেন নি তাঁর মা, বলেছেন, ‘মেয়েরা গাছে উঠলে গাছ মরে যায়’। ঘেঁটে তিনি নারীস্পর্শের সাথে গাছের বাঁচামরার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পান নি। গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে মামাবাড়ি গিয়ে ছোটমামার ঘরে একদিন ক্যাপস্টেন সিগারেটে দুটান দিয়েছিলেন কিশোরী তসলিমা। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর বড়দের কিলচাপড় থেকে বাদ যায় নি সেই কিশোরী তসলিমার পিঠের কোনো অংশ। সেদিন তাঁকে শেখানো হয় – ‘মেয়েদের সিগারেট ছোঁয়া বারণ।’ রজঃশ্রাবের সময় পবিত্র কোরান শরিফ ছুঁয়েছিলেন বলে যুবতী তসলিমার গালে কষে চড় মেরেছিলেন তাঁর মা। বলেছিলেন ‘নাপাক শরীরে পবিত্র জিনিষ ছুঁতে নেই।’পরবর্তীকালে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ণ করেন তসলিমা। ময়মনসিংহ মেডিকাল কলেজের এম বি বি এস। আজও ডাক্তার তসলিমা বুঝতে পারেন না, প্রকৃতি ও জীববিদ্যার নিয়মে সুস্থ শরীরে যা হয়ে থাকে, তার সাথে নাপাক হওয়ার কী সম্পর্ক?
(৩) সাহিত্য
এমনি সব নিষেধের মধ্যে শৈশব ও তারুন্য কাটে তসলিমার। হয়তো সেই সময় থেকে তাঁর মনোভূমিতে বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হয়, যা আজ শাখাপল্লব মেলে মহীরুহ আকার নিয়েছে। অল্প বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু – প্রথমে কবিতা – তারপর পত্র পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া। আর লেখার সুবাদেই বহুমুখী পড়াশোনার সুযোগ। বাংলা সাহিত্য, ইসলাম ধর্মগ্রন্থ, হিন্দু পুরান, বৈদিক সাহিত্য যতই অধ্যয়ন করতে লাগলেন, দেখলেন, স্মরণাতীত কাল থেকেই ছলে, বলে, কৌশলে নারীর হাতে পরানো হয়েছে শৃংখল। সকল ধর্মশাস্ত্র, সকল সমাজতাত্বিক বা সমাজপতী যুগেযুগে, দেশে দেশে, ভাষার ভিন্নতায় যা বলে গেছেন তার মূল কথা একটি ‘স্বাধীনতায় নারীর কোনো অধিকার নেই।’ কথিত আছে, ভারতবর্ষে বৈদিকযুগে নারীদের খুব মর্যাদা ছিল। কিন্তু হায়, বাস্তব যে অন্য কথা বলে। বৈদিক সাহিত্যই বহণ করে বৈদিক যুগের সকল ইতিহাস। সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, সূত্রসাহিত্য এগুলোই তো আমাদের বৈদিক সাহিত্য। তাহলে আসুন একটু খুঁটিয়েই দেখা যাক – ভারতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য – বৈদিক সাহিত্য কী বলে।
শতপথ ব্রাহ্মণ বলে, সুন্দরী বধূ স্বামীর প্রেম পাওয়ার যোগ্য। (৯/৬) অর্থাৎ অসুন্দরী বধূ স্বামীর প্রেম থেকে বঞ্চিত। তবে কি অসুন্দরীকে পবিত্র বৈদিক সাহিত্যও ক্ষমা করেনি? ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (৩৫/৫/২/৪৭) বলে, এক স্বামীর বহু স্ত্রী থাকতে পারে, কিন্তু এক স্ত্রীর একটিই স্বামী থাকবে। আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র (১/১০-৫১-৫৩) বলে, স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য, পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়া (কণ্যাসন্তান নয় কিন্তু)। আপস্তম্ভ ধর্মসূত্র আরো বলে (২/৭/১৫/১৭), নারী হোম করবে না, উপনয়নে নারীর অধিকার নেই, নারীর জন্য ব্রহ্মচর্য ও বেদ অধ্যয়ণ নিষিদ্ধ । মৈত্রায়ণী সংহিতা (৩/৬/৩, ৪/৬, ৪/৭/৪) বলে, শিক্ষা পাওয়া ও ধন অর্জন করার কোনো অধিকার নারীর নেই। শতপথ ব্রাহ্মণ (৩/২/৪/৬) বলে, যজ্ঞকালে কুকুর, শূদ্র ও নারীর দিকে তাকাবে না, কারণ ওরা অশুভ। বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র (৫/১২, ২/১, ৩, ৪৪, ৪৫) বলে নারীকে রক্ষা করবেন, কুমারী বয়সে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়। পুরানপুরুষ ঋষিরা বিশ্ববাসীকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’ (কন্যাদের জন্য নয় কিন্তু)।
তসলিমা বিশ্বাস করতে বাধ্য হন, কোনো যুগেই, কোনো সমাজেই মেয়েদের স্বাধীনতা নেই, ছিল না। তাই নতুন একটি বৈষম্যহীন সমাজগঠণের লক্ষ্য নিয়ে তিনি মন দেন লেখালেখিতেই। ১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সরকারি চিকিৎসক হিসেবে চাকুরী করেন তিনি। লেখালেখির জন্য ইতিমধ্যেই কোথাওবা হন জনপ্রিয়া, কোথাওবা বিতর্কিতা। ‘চাকুরী করতে হলে লেখা ছাড়তে হবে’ এই শর্ত না মেনে তিনি চাকুরীতেই ইস্তফা দেন, লেখাই হয় তাঁর পেশা, নেশা ও ভালবাসা।
বাংলাসাহিত্যে বিচিত্র শব্দভান্ডার দেখে বিস্মিতা হন তিনি। কত নিম্নরুচির মানুষ হলে এই সকল শব্দ সৃষ্টি করে এবং সাহিত্যে যুগযুগ ধরে তা ব্যবহৃত হয়, তা ভেবে তিনি মর্মাহয় হন। ‘ছেলেবেলা,’ ‘ছেলেখেলা,’ ‘ছেলেমানুষি’ ইত্যাদি শব্দ যা ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্যই ব্যবহৃত হয়, সেই সকল শব্দে ‘ছেলে’র প্রাধান্য তাঁকে বিস্মিত করে। ‘মেয়েছেলে’ শব্দটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মেয়ে’ শব্দটিও কি একা ব্যবহৃত হতে ভয় পায়, ছেলের সাহায্য ছাড়া? (নির্বাচিত কলাম) ‘রমন’ যার অর্থ sex, সেই শব্দটি অনায়াসে যুক্ত হল ‘নারী’র সমার্থক শব্দ ‘রমনী’র সাথে (রমন + ষ্ণি)। গৃহে থাকবে নারী, তাই তার নাম ‘গৃহিনী’ (যার চলতি রূপ ‘গিন্নি’), মহলের সাথে ‘মহিলা’, ‘অঙ্গন’-এর সাথে ‘অঙ্গনা’; নারীর সীমানা মহল এবং অঙ্গন পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হল। সংসদের বাংলা অভিধানে ‘মানুষ’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে লেখা রয়েছে, পুরুষ। ‘নারী’ মানুষ নয়। ‘মানুষ’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘নারী’ নয়। সুধীবিদগ্ধজনকর্তৃক সমাদৃত এই অভিধান তাঁকে বিস্মিত ও ক্ষুন্ন করেছে। প্রতিবাদ জানিয়েছেন বারবার। আজও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ‘রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল’ শব্দসমষ্টির বিরুদ্ধে। ‘রাষ্ট্রনেত্রী’ শব্দের ব্যবহারের জন্য আবেদন রেখেছেন, যেমন ‘সভাপতি’ (পুংলিঙ্গ) থেকে ‘সভানেত্রী’ (স্ত্রীলিঙ্গ) (‘নারীর কোনো দেশ নেই’, পৃ ১৭৯)। কিন্তু সমাজ যে মহানিদ্রায় আচ্ছন্ন। তার ঘুম কি এতো সহজে ভাঙে?
তবু সমাজের মহানিদ্রাকেই ভাঙাতে বদ্ধপরিকর তসলিমা। ধর্ম ও পিতৃতন্ত্র সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় নারীর স্বাধীনতায় – একথা বলতে গিয়েই মৌলবাদীদের বিষনজরে পড়েন তিনি। সমগ্র বাংলাদেশী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দুই বাংলার আজ তাঁর নামে মোট একুশ কোটি টাকার মামলা রুজু হয়েছে – তাঁরই সতীর্থ সাহিত্যিকদের দ্বারা। মানবতার জন্য তাঁর তথ্যভিত্তিক উপন্যাস ‘লজ্জা,’ নিজের শৈশব স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘আমার মেয়েবেলা,’ কৈশোর ও যৌবনের স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘উতল হাওয়া,’ আত্মজীবনীর তৃতীয় ও চতুর্থ খন্ড ‘ক’ এবং ‘সেইসব অন্ধকার’, ‘দ্বিখন্ডিত’ ইত্যাদি তাঁর বিতর্কিত গ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ (১৯৮৯), ‘আমার কিছু যায় আসে না’ (১৯৯০), ‘বালিকার গোল্লাছুট’ (১৯৯২)। বাংলার ১৩৯৮ সালে আনন্দ পুরষ্কার পান ‘নির্বাচিত কলাম’ গ্রন্থের জন্য। আনন্দ পুরষ্কার পান ‘আমার মেয়েবেলা’ গ্রন্থের জন্যেও। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ‘নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য,’ ‘নারীর কোনো দেশ নেই,’ ‘তুই নিষিদ্ধ – তুই কথা কইস্ না’ ইত্যাদি।
(৪) জীবনযন্ত্রণা
‘প্রেম’ শব্দটি তসলিমার শৈশব ও কৈশোরে ছিল নিষিদ্ধ একটি শব্দ। সেই পরিবেশে থাকার দরুনই নিষিদ্ধ বলেই হয়তো তিনি বেশি আগ্রহী হতেন প্রেমে। প্রেম করার অপরাধে তাঁর চিকিৎসক বাবা তাঁকে চাবুক দিয়ে পেটাতেন, ঘরবন্দী করতেন, ভাতবন্ধ করতেন, ইস্কুল কলেজও বন্ধ করে দিতেন।
কিশোরী বয়সেই যখন নানা পত্রিকায় তাঁর লেখালিখি শুরু হয়, অমনি শুরু হয় পত্রমিতালি। রোজই তাঁর ঠিকানায় চিঠি। তাজা তাজা যুবকদের। কেউ পাঠায় ছবি, কেউ কবিতা, কেউবা প্রবন্ধ। সেই সময়েই প্রেমের চিঠি লেখা শুরু করেন। এক কবির কাছে। কবি তাঁকে প্রেম নিবেদন করেছেন, সেই ডাকে সাড়া দিলেন তসলিমা। তিনি তখন তন্বী, সুন্দরী, মেডিক্যাল কলেজের প্রথমবর্ষ। তিনি ভালোবাসেন কবির কবিতা আর ভীষণভাবে ভালোবাসেন প্রেম। সেই প্রেমের শক্তিতেই বাড়ি ছেড়ে, গোপনে বিয়ে করেন, নোটারি পাবলিকের কাগজে। আষ্টেপৃষ্টে তাঁকে প্রেম এমনই বেঁধেছিল, তিনি দেখতে পান নি প্রেমিক আসলে তাঁকে ভালোবাসে না, ভালোবাসে রমণী আর রমণ। তার কাছে প্রেমিকার আর গণিকার শরীরে কোনো পার্থক্য নেই। সে চায় প্রথামত একটি স্ত্রী আর দিনে রাতে বিনে পয়সার নিশ্চিত সম্ভোগ। প্রেমিকের শরীরে যৌনব্যাধি। যে ব্যাধিতে তসলিমাকে আক্রান্ত করতে সামান্যও দ্বিধা নেই তার। না – সে তসলিমার প্রেমিক নয় – তিনিই কেবল বধির বোকা বালিকা – যে ‘প্রেম প্রেম’ করে উন্মাদ হয়েছিল।
শুরু হল এক পথ চলা। দীর্ঘ দীর্ঘ সময় জুড়ে, উতল যৌবনজুড়ে একা থাকা। পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁকে দৃঢ়, দুর্বিনেয়, আত্মবিশ্বাসী করেছে। তিনি স্বনির্ভর এক চিকিৎসক-লেখক। কিন্তু কোনো একদিন ফাগুন হাওয়ায় আবার খুলে যায় হৃদয়ের দুয়ার। চোখের সামনে আশ্চর্য্য সুন্দর এক যুবক – চোখে তার মুগ্ধতা। আবার শুরু হয় তীক্ষ্ণ, তীব্র, দুর্দমনীয় প্রেমের। যুবকের সাথে তাঁর প্রেম। রাস্তায় হাত ধরে হাঁটা, নির্জনে নিভৃতে মগ্ন, মত্ত হওয়া। যুবককে প্রেমিকে নির্মাণ করেন তসলিমা, তাঁর ত্যাগে বা বিসর্জনে নয়, প্রেমে। তসলিমার সৌন্দর্য্য, ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ব, প্রাণময়তার কাছে যুবক বড় ম্লান, তবু তসলিমাকে ছাড়া সে বাঁচবে না, জগতে তসলিমা ছাড়া তার অন্য কেউ নেই – তখন এমন। ঠিক তখনই শঠবাদ, পুরুষবাদ, মৌলবাদ, তসলিমার লেখার বিরুদ্ধে মিছিল করছে, তাঁর ফাঁসী চেয়ে। সেদিন প্রাণভয়ে পালাতে চাইছেন তসলিমা, রাতের চাদর মুড়ে দৌড়াচ্ছেন। তখন প্রেমিককে খোঁজেন, কোথায় সে? না – সে নেই। নিরাপদ দূরত্বে সে তার জীবন যাপন করছে। তসলিমার বিশ্বাস ধ্বসে পড়ে প্রবল ভূমিকম্পে ন-তলা দালানের মত।
এরপর উত্তর ইউরোপের শীতার্ত নির্বাসিত জীবন। প্যারিসবাসী তসলিমা আবার অনুভব করেন একাকিত্বের যন্ত্রনা। প্রেম পেতে পেতে বছর গড়ালো। ফরাসি এক যুবক, তুলুজ শহরবাসী। উতল প্রেমে ভাসেন তসলিমা। ফরাসি যুবক তুলুজ থেকে উড়ে আসে ছুটিছাটায়। বিমানে, বাসে, নৌকায়, রেস্তোঁরায় আবার স্নিগ্ধ হন প্রেমের স্পর্শে। ফরাসি যুবক তাঁকে প্রেমের অন্য ভুবন দেখায়। যে ভুবনের ত্রিসীমানায় কোনো বাঙালী যুবক তাঁকে নেয়নি আগে। প্রেম যে এতো সমতার, এতো গৌরবের তা তিনি আগে বোঝেন নি। হঠাৎই অধিকারবোধ চলে আসে ফরাসি যুবকের। প্যারিস ছেড়ে তুলুজ-এ যেতে বাধ্য করে তসলিমাকে। না, রাজী নয় তসলিমা। তুমি বরং তুলুজ ছেড়ে চলে এসো প্যারিস। প্যারিসে তসলিমার কাজ তখন অর্ধাবস্থায়। প্যারিস ছাড়া তাই তাঁর পক্ষে অসম্ভব। ফরাসি যুবকের ঈর্ষা, তসলিমার দৃঢ়তা তাঁদের সম্পর্ককে একটানেই দাঁড় করিয়ে দেয় বিচ্ছেদের পাড়ে।
আবার কয়েক বছর নিঃশব্দতায়। লেখায়, পড়ায়, দর্শনে, শিল্পে, ভ্রমণে ডুবে থাকা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ করেন তসলিমা। বাংলা তখন হৃদয়, বাঙালী তখন স্বপ্ন। ই-মেলে, ফোনে আবার প্রেম। কলকাতার যুবক। প্রতিদিন কলকাতা-কেমব্রিজ। প্রতিদিন সুপ্রভাত শুভরাত। প্রেম কবিতার শব্দে, অক্ষরে, প্রেমে তোড়ে জীবন ভাসে। যখন প্রেমিকের সাথে প্রথম দেখা, আকুল হন তার জন্য। অবশেষে স্তম্ভিত হন দেখে যে, এতকাল প্রেমের জলে তাঁকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে তাঁর প্রেমিক পুরুষ অক্ষমাযোগ্য অপরাধ করতে এতটুকু দ্বিধা করেনি একটি সত্য লুকিয়ে রেখে যে, সে উত্থানরহিত।
সেই প্রথম – জীবনের মতো কাঁদেন তিনি। সেইসব অন্ধকারময় দিন পেরিয়ে কঠোর বাস্তবের রুক্ষ মাটির আঘাত পেয়ে খন্ড বিখন্ড হয়ে লুটিয়ে পড়েন না তসলিমা, বরং জেগে ওঠেন আরো তেজে, শক্তিতে, আত্মবিশ্বাসে। তাঁর উপলব্ধি –
‘তারা ঠগ। প্রতারক। হিপোক্রেট। ভীতু। ভন্ড। তারা প্রেমিক ছিল না একজনও। আজ বেলায় এসে দুখের দিনগুলোকেও যে সুখের দিন ভেবে সুখ পেতাম, টের পাই। হৃদয় নিংড়ে প্রেম দিয়েছি, যাদের দিয়েছি, বুঝি তারা পুরুষ ছিল সবাই, প্রেমিক ছিল না।’ (‘নারীর কোনো দেশ নেই’, পৃষ্ঠা ৪১)
(৫) আন্তর্জাতিক সম্মান
তসলিমা নাসরিন প্রচুর পুরস্কার ও সম্মান অর্জন করেছেন, যার মধ্যে আছে ইউরোপীয় সংসদ থেকে মুক্তচিন্তার জন্য শাখারভ পুরস্কার, সহিষ্ণুতা ও শান্তি প্রচারের জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার, ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ফ্রান্সের এডিট দা নান্ত পুরস্কার, জার্মানীর মানববাদী সংস্থার আরউইন ফিশার পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিথট্ হিরোইন পুরস্কার, ফ্রান্সের দ্য আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিস থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট। তিনি আমেরিকার হিউম্যানিস্ট একাডেমির হিউম্যানিস্ট লরিয়েট। পৃথিবীর ত্রিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থসমূহ। মানবতাবাদ, মানবাধিকার, নারীস্বাধীনতা ও নাস্তিকতা বিষয়ে তিনি বর্তমান পৃথিবীতে নিজেই একটি আন্দোলনের নাম।
মানবতার একটি আলোকশিখা তসলিমা। আমার ভাষায় তিনি বর্তমান পৃথিবীর মহিষাসুরমর্দিনী রণচন্ডী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও পিতৃতান্ত্রিক পরিবাররূপী অসুর সংহারে তিনি অগ্নিবর্ণা, অগ্নিলোচনা। শত বৎসরের সহস্র সহস্র নারীর যন্ত্রনার অবসান ঘটাতেই আজ তিনি রণক্ষেত্রে অবতীর্ণা। তাইতো তিনি বলেন, ‘আমরা নারীরা আজ কাকে কী করে বলবো যে আমরা ভাল নেই! হাজার বছর ধরে পিঠে কালশিটে, চোখ নির্ঘুম, হাজার বছর থেকে আমরা ভাষাহীন। নারীর কণ্ঠে এবার ভাষা উঠে আসুক, স্ফুলিঙ্গ হোক সে, আগুনের মত ছড়িয়ে যাক সবখানে। নারীরা পুড়ে পুড়ে ইস্পাত হোক, নারী শক্তিময়ী হোক।’
‘আমাকে থাকতে দাও আমার মতো, নির্বিবাদে, ভাষায়, ভালবাসায়। আমাকে থাকতে দাও আমার মায়ের কাছে, আমার মায়ের চোখের জল ধুয়ে দেবে আমার গায়ের ধুলোকালি। আমার মায়ের কোল থাকবে আমার জন্য, ওই কোলে সুখে কিংবা দুঃখে আমি ফিরব, মা তো চিরদিনই ডাকতেন আমাকে, তাঁর কোলে।’
‘জীবন সঁপিয়া জীবনেশ্বর
পেতে হবে তব পরিচয়
তোমার ডঙ্কা হবে যে বাজাতে
সকল শঙ্কা করি জয়।
…তিমির রাত্রি পোহায়ে,
মহাসম্পদ তোমারে লভিব
সব সম্পদ খোয়ায়ে।
মৃত্যুরে লব অমৃত করিয়া
তোমার চরণ ছোঁয়ায়ে।’
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
রচনা – কিরণময় দাস
[বাংলা হরফে প্রতিলিখন – দেবর্ষি দাস]